
প্রায় দুই সপ্তাহের টানা সংঘর্ষ শেষে ইরান ও ইসরায়েল এক অঘোষিত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছালেও এর ভিত্তি যে নড়বড়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শান্তির পথ নয়, বরং একটি অস্থায়ী বিরতি মাত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও এর কার্যকারিতা শুরুর আগেই উভয় পক্ষ শেষ মুহূর্তে পাল্টাপাল্টি হামলা চালায়।
শেষ মুহূর্তের হামলার নাটক
পূর্বঘোষিত যুদ্ধবিরতির সময় ছিল সোমবার ভোর চারটা (তেহরান সময়)। কিন্তু তার কিছুক্ষণ আগেই ইসরায়েল পশ্চিম ইরানে বিমান হামলা চালায়। ইরান জবাবে তেল আবিব, হাইফা ও বেয়ারশেভায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে এবং সকাল সাতটা ৩০ মিনিটে যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা শুরু ঘোষণা করে। ইরান জানায়, এই হামলা ছিল সীমিত প্রতিশোধমূলক, নতুন করে যুদ্ধ শুরুর উদ্দেশ্যে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
এর আগে রবিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বাংকার ধ্বংসকারী বোমা নিক্ষেপ করে। পাল্টা জবাবে ইরান কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরান এই হামলার কোডনেম দেয় ‘বিজয়ের সুসংবাদ’। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। ট্রাম্প একে ‘দুর্বল হামলা’ আখ্যা দিয়ে ইরানকে আগাম সতর্ক করার জন্য ধন্যবাদ দেন এবং এটিকে ‘শান্তির সময়’ বলে উল্লেখ করেন।
তবে আল-উদেইদ ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর কাতারের আকাশে বিস্ফোরণ ও ফ্লেয়ারের আলো জনমনে শঙ্কা ছড়ায়। আকাশসীমা সাময়িক বন্ধ করা হয় এবং মানুষ আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। কাতারে অবস্থানরত প্রবাসীরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
এর আগে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাস কাতারে অবস্থানরত নাগরিকদের বাইরে না বের হওয়ার এবং নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয়। কাতার সরকারও নাগরিক ও ভিজিটরদের নিরাপত্তার জন্য আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে।
আল-উদেইদ ঘাঁটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি, যা প্রায় ১০ হাজার মার্কিন সেনা সদস্যের আবাসস্থল। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড -এর ফরওয়ার্ড সদর দপ্তর হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এবং ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের সামরিক অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মার্কিন ঘাঁটি আল-উদেইদ-এ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর কাতারের আকাশে বিরল দৃশ্য দেখা গেছে, যা দেশটির নাগরিকদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা বয়ে আনে।
ইরাকের মার্কিন ঘাঁটি ঝুঁকিতে
ইরানি ঘনিষ্ঠ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হুমকিতে এখন ইরাকের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোও ঝুঁকিতে রয়েছে। ইরাকি সরকারের জন্য এটি কূটনৈতিক ভারসাম্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক জটিলতা কাতার এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে তীব্র নিন্দা জানায় এবং ইরানকে দায়ী করে। তবে কাতার একই সঙ্গে ইসরায়েলের তেহরান হামলাকেও সঙ্কটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।
কাতার এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয়, যা জিসিসি সদস্য দেশগুলোর সমর্থন পায়। হরমুজ প্রণালীর নিরাপত্তা ও তেল সরবরাহের জন্য স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান দিয়েই বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তেল পরিবাহিত হয়। বড় সংঘর্ষ হলে এই প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা দেখা দেবে।
যুদ্ধবিরতির বাস্তবতা ও ভঙ্গুর ভিত
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তির পথে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নয়। সংঘর্ষ নতুন ভূরাজনৈতিক ক্ষত তৈরি করেছে, আঞ্চলিক জোটগুলো দুর্বল হয়েছে এবং জাতীয়তাবাদী আবেগ তীব্র হয়েছে।
এই মুহুর্তে কার্যকর যুদ্ধবিরতির জন্য প্রয়োজন দোষ স্বীকার, ক্ষতির স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক নিন্দা ও নিশ্চয়তাÑতার কোনোটিই কার্যকর হয়নি। ইসরায়েল ও ইরান কেউই দায় স্বীকার করতে বা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামোয় আস্থা রাখতে আগ্রহী নয়।
ইরান-ইসরায়েলের এই যুদ্ধবিরতি আপাতত বড় সংঘর্ষকে থামিয়েছে বটে, তবে এটি স্থায়ী শান্তির গ্যারান্টি নয়। নতুন করে উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কা রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।