
ইরান-ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠেছে হরমুজ প্রণালী। কেননা, ইরান বারবার হুমকি দিয়েছে আসছিল-যদি তাদের স্বার্থে আঘাত আসে, তাহলে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। যদিও চলমান সংঘাত ৯ দিনে গড়ালেও ইরান এই প্রণালী নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো তৎপরতা দেখায়নি।
তবে গত শনিবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হামলার কারণে হরমুজ প্রণালী বন্ধের শঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে। যদি ইরান এই প্রণালী বন্ধ করে দেয় বা এতে কোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করে তাহলে এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্ববাজারে তেলের দামের উল্লম্ফন। এটি শুধু পরিবহণ খরচ বাড়াবে না, বরং অনেক দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার কারণ হতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা।
পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর এবং আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করার একমাত্র সমুদ্রপথ এই হরমুজ প্রণালী। প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (প্রায় ২ কোটি ব্যারেল) এই প্রণালী দিয়েই পরিবাহিত হয়। সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং ইরানের মতো প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের উৎপাদিত জ্বালানি এই পথ দিয়েই রপ্তানি করে। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলো—যেমন চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের জ্বালানির সিংহভাগের জন্য এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল।
এই সংকীর্ণ জলপথ, যার সবচেয়ে কম প্রস্থ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার, ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এর মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রতিটি ট্যাঙ্কার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বহন করে। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য কর্তৃপক্ষ ইআইএ একে ‘বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহণ চোকপয়েন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
জ্বালানি ও পরিবহণ বাজার পরামর্শক সংস্থা ভরটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, কনডেনসেট এবং জ্বালানি এই জলপথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি রপ্তানিকারক দেশ কাতারও এই প্রণালীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
বর্তমান পরিস্থিতি কী?
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যকার সংঘাতে এই জলপথের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। ইরান অতীতে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিয়েছিল পশ্চিমা চাপের জবাবে। যদিও বর্তমানে সরাসরি কোনো বাণিজ্যিক জাহাজে বড় হামলার খবর নেই। তবে ইরানের পরামাণুবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর থেকে জাহাজ মালিক এখন জলপথ ব্যবহার নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে, আবার কেউ কেউ রুট বাতিল করেছে বলে এপি জানিয়েছে।
রয়টার্সের বরাতে জানা গেছে, সম্প্রতি এই অঞ্চলে নৌযান পরিচালনায় ইলেকট্রনিক হস্তক্ষেপ বেড়ে গেছে, যা জাহাজ চলাচলে প্রভাব ফেলছে। এই সংঘাত দ্রুত শেষ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই, ফলে তেলের বাজারে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। প্রণালীতে কোনো ধরনের বিঘ্ন বা অবরোধ তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি বিশেষত এশিয়ার আমদানিকারকদের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। তেলবাহী ট্যাংকারের ভাড়া ইতোমধ্যেই বেড়েছে। ব্লুমবার্গের মতে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে পূর্ব এশিয়ায় জ্বালানি পরিবহণের খরচ মাত্র তিন সেশনে প্রায় ২০% বেড়েছে৷ পূর্ব আফ্রিকার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি ৪০%-এরও বেশি।
সরবরাহ বিঘ্ন হলে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
ইআইএর তথ্য অনুযায়ী, হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়া জ্বালানি ও তেলের প্রায় ৮২% গন্তব্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। চীন, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এই চারটি দেশ সম্মিলিতভাবে এই প্রণালী দিয়ে যাওয়া তেল ও কনডেনসেটের প্রায় ৭০% আমদানি করে৷ ফলে এই দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে।
ইরান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর কী প্রভাব পড়বে?
ইরান যদি প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তাহলে তা মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ টেনে আনতে পারে। এই অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন পঞ্চম নৌবহর বাণিজ্যিক জাহাজ রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে। ইরানের এমন কোনো পদক্ষেপ সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। তাছাড়া, ইরান নিজেও এই প্রণালী ব্যবহার করে তেল রপ্তানি করে৷ ফলে এটি বন্ধ করা আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে।
জেপি মর্গানের বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘ইরানের অর্থনীতি এই জলপথে পণ্যের অবাধ চলাচলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল৷ এই প্রণালী বন্ধ করা তার প্রধান গ্রাহক চীনের সঙ্গে সম্পর্কের জন্যও ক্ষতিকর হবে।’
প্রণালীর বিকল্প কী?
সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ইতিমধ্যেই বিকল্প রুট তৈরি করেছে৷ সৌদি আরব ‘ইস্ট-ওয়েস্ট ক্রুড অয়েল পাইপলাইন’ চালায়, যার ক্ষমতা দৈনিক ৫০ লাখ ব্যারেল। সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি পাইপলাইন স্থাপন করেছে, যা তাদের স্থলভাগের তেলক্ষেত্রকে ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করে। ইআইএর হিসেব অনুযায়ী, হরমুজ প্রণালীতে বিঘ্ন ঘটলে দৈনিক প্রায় ২৬ লাখ ব্যারেল তেল বিকল্প পথে পরিবহণ সম্ভব।