
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর দেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ‘মব জাস্টিস’ বা উত্তেজিত জনতার হাতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। গত ১০ মাসে মব সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে ১৭৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এছাড়া হেনস্থার শিকার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য মানুষ।
সর্বশেষ গত ২২ জুন উত্তরা এলাকায় সাবেক সিইসি মুক্তিযোদ্ধা কে এম নূরুল হুদার বাসায় মব আক্রমণ চালায়। তাকে হেনস্তা করে ডিম ছোঁড়া হয়, গলায় জুতার মালা পরানো হয়। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মোহাম্মদ সাজ্জাত আলী বলেন, ‘মব ঠেকাতে ব্যর্থ হলে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে ডাকাতি ও ছিনতাই মামলা রুজু করা হচ্ছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে প্রাণ হারিয়েছেন ৮০ জন, চট্টগ্রামে ২৯ জন, বরিশালে ১৭ জন, রাজশাহীতে ১৬ জন, খুলনায় ১৪ জন, রংপুরে সাতজন, ময়মনসিংহে ছয়জন এবং সিলেট বিভাগে পাঁচ জন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘মব ছোঁয়াচে অসুখের মতো। আইনের শাসনের প্রতি আস্থা না থাকলে এ ধারা ভয়াবহ রূপ নেয়। মবকে জামিন অযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এটি আরও বিস্তার লাভ করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে দ্রুত বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণেই মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। মব নিয়ন্ত্রণে আইনের কার্যকর প্রয়োগ ও দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তোফাজ্জল হোসেন। মৃত্যুর আগে ক্ষুধার্ত তোফাজ্জল ভাত খেতে চেয়েছিলেন, তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার দেওয়া হয়—তারপরই চলে পিটুনি।
এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা, ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল্লাহ আল মাসুদ এবং ১৪ জুন গাজীপুরে শাহরিয়ার রহমান একইভাবে প্রাণ হারান উত্তেজিত জনতার হাতে।
একইভাবে ২৭ এপ্রিল গাজীপুরে মাওলানা রইস উদ্দিনকে পূর্বশত্রুতার জেরে মব তৈরি করে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী জানান, মিথ্যা অভিযোগে গাছের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনের পর মৃত্যু হয় তার স্বামীর।
এসব হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, মব ভায়োলেন্স কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পুলিশ মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।
তবে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু কথার আশ্বাস নয়, মবকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
সরকার ও প্রশাসন বারবার কঠোর বার্তার কথা বললেও বাস্তবে মব সৃষ্টিকারীরা দাপটের সঙ্গে নিজেদের বিচার চালিয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘মব জাস্টিস কাম্য নয়, পুলিশ বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে শাস্তি পাবে।’
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম হুঁশিয়ারি দেন, ‘মব জাস্টিস করলে সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হবে।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে দোষিদের আটক করা যাচ্ছে না। আবার কেউ আটক হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে সহজেই।