
বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বৈশ্বিক যুদ্ধ, সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেল সংকটের মতো পরিস্থিতি মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সঞ্চয় না থাকায় মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থাগুলোর প্রমিত মান অনুযায়ী, আমদানিনির্ভর দেশগুলোকে অন্তত ৯০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত রাখতে হয়। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য বলছে, বর্তমানে ডিজেল মজুত রয়েছে মাত্র ২৭ দিনের জন্য, অকটেন সাতদিন, পেট্রোল আটদিন ও ফার্নেস অয়েল ২৮ দিনের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বা পরিবহন বিলম্বে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কারখানা এবং কৃষিখাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
চাহিদা বাড়ছে, মজুত বাড়ছে না
বিপিসি বলছে, বর্তমানে দেশের বার্ষিক জ্বালানি চাহিদা প্রায় ৭২ লাখ টন, যার ৯২ শতাংশই আমদানি নির্ভর। অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ মজুত সক্ষমতা ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৩০ টন যা মোট চাহিদার মাত্র ২২ শতাংশ।
১৯৭১ সালে দেশের বার্ষিক চাহিদা ছিল মাত্র ১১ লাখ টন, যা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ২০৩০ সালে গিয়ে ৯১ লাখ টনে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মজুত অবকাঠামো সে তুলনায় বাড়ছে না।
জরিমানা গুনছে বিপিসি
স্টোরেজ স্বল্পতার কারণে প্রায়ই বিদেশ থেকে আনা তেলবাহী জাহাজ বন্দরে পড়ে থাকে, তেল নামানো যায় না। এতে বিপিসিকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা।
বিপিসির বাণিজ্য ও অপারেশন্স বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মণি লাল দাশ বলেন, ‘স্টোরেজ ক্যাপাসিটি কম থাকায় অনেক সময় জাহাজ বসিয়ে রাখতে হয়। এতে আমাদের মোটা অঙ্কের ডেমারেজ (জরিমানা) গুনতে হয়।’
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসি সরবরাহ করেছে ৬৭ লাখ ৬১ হাজার টন পেট্রোলিয়াম জ্বালানি। এর মধ্যে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৪২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৭৯ টন। যা মোট চাহিদার প্রায় ৬৩ শতাংশ। অথচ গত ৫ বছরে ডিজেলের স্টোরেজ সক্ষমতা উল্টো কমেছে ২৩ হাজার ৭২৯ টন।
বেসরকারি লোভের ফাঁদে সরকারি অবকাঠামো
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম অভিযোগ করেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ মজুত ক্ষমতা বাড়াতে আগ্রহী নন। কারণ সরকারি অবকাঠামো বাড়ালে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কোনো লাভ হয় না। বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ট্যাংক ভাড়া নিলে তারা কমিশন পান।’তিনি আরও বলেন, ‘তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন, যাতে জনগণের পক্ষ থেকেই দাবি উঠেÑবেসরকারি ট্যাংক ভাড়া নিতে হবে। তখন সরকার ‘জরুরি পরিস্থিতি’ বলে তাদের অনুমোদন দিয়ে দেবে।’
ডিপোগুলো পুরোনো, প্রকৃত মজুত নয়
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ডিপো এখন অনেকটাই পুরোনো। ফলে নতুন আন্তর্জাতিক মানের ট্যাংক নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে দেখানো মজুতের মধ্যেও প্রায় ১০ শতাংশ ডেড স্টক থাকে, যা ব্যবহারযোগ্য নয়। বাস্তবে কার্যকর মজুত আরও কম।’
নতুন ট্যাংক ফার্মের উদ্যোগ ধীরগতির
বর্তমানে দেশে ২৭টি ডিপোতে মোট ১৫ দশমিক ৮৪ লাখ টনের তেল মজুত করার সুবিধা থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। বর্তমানে পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েলে দুটি, মেঘনা ও যমুনা অয়েলে দুটি করে মোট ৮০ হাজার টনের নতুন ট্যাংক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে কাজ চলছে ধীর গতিতে।
এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞরা বেশকিছু সুপারিশ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছেÑ৯০ দিনের মজুত নিশ্চিত করতে অবকাঠামো গড়ে তোলা, প্রাদেশিক পর্যায়ে নতুন ট্যাংক ফার্ম নির্মাণ, বেসরকারি ট্যাংক ব্যবহারে নির্ভরতা না বাড়িয়ে সরকারিভাবে বিনিয়োগ, বিপিসি পরিচালনায় অভিজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
তারা বলছেন, দেশের উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ নির্ভর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। পরিকল্পনাহীনতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লোভী গোষ্ঠীর সুবিধাবাদিতা ঠেকাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতেই বাংলাদেশকে জ্বালানি সংকটের মুখে পড়তে হতে পারে।