
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঘিরে আগামী বছরটি আরও কঠিন হতে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের সংকট এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা- সব মিলিয়ে এখন অর্থনৈতিক টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনে কঠিন সময়ের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে- এমন চিত্রই উঠেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ পূর্বাভাসে। চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নামতে পারে এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দুই আন্তর্জাতিক সংস্থা।
গত ২৩ জুন ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় বাংলাদেশকে এক দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৮০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় সংস্থাটি। তবে এ অর্থায়নের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া পূর্বাভাসে উঠে আসে কঠোর সতর্ক বার্তা।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইজেল ক্লার্ক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুস্তরীয় চাপে রয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’
মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘গুগল পে’ সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। গভর্নর বলেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামাতে চায়। তবে আমরা আরও আগ্রাসী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি- ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে সেটাই হবে আমাদের সফলতা।’
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। আইএমএফ এই প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক আট শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যা সরকারি হিসাবকেও ছাড়িয়ে গেছে নিচের দিকে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও পরিস্থিতি ভালো হবে না- জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাঁচ দশমিক চার শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে। জুনেই বিশাল ঘাটতি পূরণের চ্যালেঞ্জ আছে, যা বিশ্লেষকদের মতে প্রায় অসম্ভব। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। খেলাপি ঋণ এখন চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বছরের শেষ নাগাদ এটি আট লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। জ্বালানি ও খাদ্যের বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করছে। হরমুজ প্রণালিতে জ্বালানি পরিবহন বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে বলে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে।
সরকার ব্যাংক খাত থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নেবে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্তি আরও কঠিন হবে এবং সুদের হার বাড়বে। এরই মধ্যে বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে ভাটা পড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই সংকট কাটানো কঠিন হবে। আইএমএফও একই মত দিয়েছে এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও আর্থিক খাত সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে।