
মেয়েটিকে কখনো কখনো দেখা যেতো মিছিলের একেবারে অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে খালি গলায় স্লোগান দিতে। আবার কখনো দেখা মিলতো হ্যান্ড মাইক্রোফোন হাতে ইজিবাইকের চালকের পাশে বসে স্লোগানের ঢেউ তুলতে। ২৪’র জুলাইয়ের ছাত্র-গণ জমায়েত উত্তাল হয়ে উঠতো উচ্চ-মাধ্যমিক প্রথম বর্ষ পড়ুয়া ফারিহা খান ঝিলিকের অনবদ্য কণ্ঠের স্লোগানে স্লোগানে...। প্রশাসন ও ছাত্রলীগের অব্যাহত হুমকি এবং ভয়ভীতির মুখেও একটি দিনের জন্যও জুলাই আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে পেছপা হননি তিনি। অথচ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছেন!
মেধাগতসহ যোগ্যতার অন্যান্য সব মাপকাঠিতে এগিয়ে থাকার পরও বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির কারণে সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগ বঞ্চিত হন জুলাই আন্দোলনের ‘স্লোগান কন্যা’ ঝিলিক। ২০২৪ সালের ১৬ মার্চ সেনবাহিনীতে চাকরির পরীক্ষায় ‘মার্চ’ ও মৌখিক পরীক্ষা ছিল ঝিলিকের। লিখিত পরীক্ষায় ৫০’র মধ্যে ৪৭ পেয়েছিলেন। উচ্চতা ও ওজনসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তিন তিনবার মৌখিক পরীক্ষার পর তাকে ‘রিজেক্ট’ করা হয়।
ঝিলিক বলেন, ৪০০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে আমিসহ আরেকজন কোনো কোটা না থাকায় মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যাই। আমাদের বদলে মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য-কোটাধারী দু’জন সেনবাহিনীর চাকরি পায়। আমাদের তখন শান্তনা দেওয়া হয়- ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এরচেয়ে আরো ভালো কিছু হয়তো অপেক্ষা করছে।
তিনি আরো বলেন, এ ঘটনাটি মনে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। আর সেদিনের পর ১৭ জুলাই থেকে সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মানসে দেশে চলমান তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই। শত বাধা বিপত্তি ও হুমকি-ধামকি উপক্ষো করেও লড়াইয়ের ময়দানে সম্মুখ সারিতে শামিল ছিলাম; এখনো লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাইনি।
দৈনিক রানারের সাথে এক আলাপচারিতায় জুলাই যোদ্ধা ফারিহা খান ঝিলিক জানান, মূলত কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হলেও ভেতরে ভেতরে আরো অনেক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল আমাদের। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে কোনো বাক স্বাধীনতা ছিল না। মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছিল। একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিরাজ করছিল দেশে। এসব থেকে পরিত্রাণের একটি পথ খুঁজছিলেন দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ। এক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থান অভিমুখী একটি লড়াইয়ে প্রবেশের পথ তৈরি করেছিল। রাষ্ট্র সংস্কার, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা নির্মূল, গণতন্ত্র পুঃনপ্রতিষ্ঠা-সর্বোপরি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো বদলের উদ্দেশ্যে মুক্তিকামী জনতা এই আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল।
জুলাই আন্দোলনের সময় আপনি ‘স্লোগান কন্যা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন; এক্ষেত্রে স্লোগান দেওয়ার ব্যাপারে পূর্বের অভিজ্ঞা ছিল কী না এমন প্রশ্নে ঝিলিক বলেন- এরকম কেনো অভিজ্ঞতা কখনোই আমার ছিল না। মাঠের আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই এটি অর্জন হয়েছে। তিনি বলেন, আমি এই চিন্তা থেকেই মিছিলের সামনে চলে গিয়ে চলে স্লোগান দিতাম যে, আমাকে দেখে যাতে আরো অন্য মেয়েরাও সাহস পায়।
তিনি বলেন, আন্দোলনের ওই দিনগুলোতে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে স্লোগান দিতাম। গলার জোর কমে গেলে মাউথস্পিকার হাতে নিয়ে মাইকে স্লোগানে দেওয়া চলতো। নিরাপত্তার জন্য হাতে লাঠিও রাখতাম। আবার কখনো থাকতো প্লাকার্ড বা ফেস্টুন।
জুলাই আন্দোলনের একটা পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ বিপুল মাত্রায় বাড়তে থাকে। ছেলেদের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক নারী শিক্ষার্থীরা এতে যোগ দেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সেইসব নারীরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন। এখনকার কোনো কর্মসূচিতে তাদের আর উপস্থিত থাকতে দেখা যাচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নে ঝিলিক জানান, মূলত অবমূল্যায়নের কারণে সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কমে গেছে। জুলাই আন্দোলনে সামনের ও মাঝের; এমনকি পেছনের সারিতেও ছিলেন না- এমন অনেকে ৫ আগস্টের পর সামনের সারিতে চলে এসেছেন। আন্দোলনে কখনো অংশ নেননি এমন মানুষদের দৌরাত্ম্যের মুখে অনেকে অপমান-অপদস্তের ভয়ে ‘সাইড লাইনে’ চলে গেছেন। আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সামনের সারিতে চলে আসা এসব অপরিচিত মুখগুলো জুলাই আন্দোলন চলাকালে অনলাইন প্লাটফরমেও সক্রিয় ছিলেন না।
তিনি আরো বলেন, জুলাই আন্দোলনকারীদের এখন নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। নতুন করে আর কোনো আন্দোলনে না জড়াতে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের নারীরা অনলাইনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এগুলোও নারীদের দূরে সরে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
জুলাই যোদ্ধা ফারিহা খান ঝিলিক মনে করেন- ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তিকে নির্মূল এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রূপান্তরিত না করা পর্যন্ত জুলাই আন্দোলনের চেতনার বাস্তবায়ন সম্ভব না। আর তাই এগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত না বাস্তবায়ন হচ্ছে; ততদিন তারা রাজপথ ছাড়ছেন না- আরও যোগ করেন তিনি।