
সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে মত গঠনের লক্ষ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে ছোট ছোট বৈঠক করতেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া মেয়েরা হোস্টেল ও মেসে ফিরে গিয়ে অন্যদেরও চাকরিতে ‘কোটা নয় মেধার’ স্বপক্ষে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাতেন। আর যশোরে এভাবেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামতে নারী শিক্ষার্থীরা উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন ক্রমশ।
কিন্তু একপর্যায়ে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হুমকি দেওয়া শুরু করে ছাত্রলীগ। এরপর প্রশাসনের দিক থেকেও নানাভাবে ‘থ্রেট’ আসতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে সশরীরে ওঠাবসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে ফেসবুক মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ গড়ে তুলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নারী শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করতে থাকেন। সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী খন্দকার রুবাইয়ার হাত ধরে যশোরে এভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
এরপর আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে নারী শিক্ষার্থীরা খন্দকার রুবাইয়াদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। কখনো রাজনীতি করেননি। মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেননি; এমন সব রাজনীতি বিমুখ মেয়েরাও হাসিনার মসনদ কাঁপানো শ্লোগানে প্রকম্পিত করেন যশোরের রাজপথ। জেলা শহর ছাপিয়ে উপজেলা পর্যায়েও এই আন্দোলনের ঢেউ গিয়ে লাগে। ছেলেদের পাশাপাশি হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থী প্লাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হয়ে আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। ছাত্রলীগ ও পুলিশের সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় হাতে লাঠি তুলে নেন মেয়েরা। আন্দোলনরত ছেলেদের রক্ষায় মিছিলের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।
জুলাই আন্দোলনের সেই রক্তাক্ত দিনগুলি নিয়ে দৈনিক রানারের সাথে এক আলাপচারিতায় খন্দকার রুবাইয়া জানান, এই আন্দোলনে যখন তিনি জড়িয়ে পড়েন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঢাকায় আন্দোলন শুরু হলে যশোরেও কীভাবে আরম্ভ করা যায় সেই ব্যাপারে ভাবতে থাকেন। সেই ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে সরাসরি মাঠেও নামেন। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখ থেকে ক্যাম্পাসে ছোট ছোট বৈঠক করতে থাকেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলতে ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ গঠন করেন।
রুবাইয়া বলেন, কোটার কোনো ক্যাটাগরির মধ্যে আমি নেই। তাই বলে কি আমার যোগ্যতার মূল্যায়ন হবে না? কোটা নেই বলে কী সরকারি কোনো ভালো চাকরি আমি ও আমার মতো অন্যরা পাবে না। তাই বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। প্রথম দিকে সাড়া কম পাই। এদিকে, দিন যত গড়াতে থাকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের দমন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে ততই থাকে। এতে আন্দোলন নিস্পন্দ হবে বলে শাসকেরা ভাবলেও আরো দুর্বার হয়ে উঠতে থাকে। ছেলেদের মতো হাজার হাজার নারী শিক্ষার্থীর ভিড় বাড়তে থাকে আন্দোলনের মাঠে।
তিনি বলেন, যশোরের আন্দোলন অনেক শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু দেশব্যাপী ভয়াবহ হত্যা-নির্যাতনের একপর্যায়ে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম ধারণ করে। ওই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে এরপর আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্রোতকে ধারণ করে; বৈষম্যহীন একটি নতুন বাংলাদেশে গড়ার প্রত্যয়ে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে জীবনঝুঁকি নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলন ঝাঁপিয়ে পড়ি।
যশোরের আন্দোলনে পুলিশের সাথে শিক্ষর্থীরা সেভাবে সংঘাতে না জড়ালেও ১৬ জুলাই পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। এদিন পৌরসভার সামনের সড়ক দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ সুপারের সাবেক কার্যালয়ের সামনে বেধরক লাঠি চার্জ করে কোতয়ালি থানার পুলিশ ও ডিবি পুলিশ। ছেলেদের পাশাপাশি মিছিলে থাকা মেয়েদেরও লাঠিপেটা করে পুলিশ সদস্যরা। আহতদের অনেকেই সেদিন যশোর জেনারেল হাসপাতাল ভর্তি হন। পরবর্তীতে অনেকেই এই আন্দোলনের সময় বিভিন্নভাবে হুমকি, হামলা ও নির্যাতনে শিকার হয়েছেন। হাসিনা যেদিন পালিয়ে যান-৫ আগস্ট; সেদিন আমিও মিছিল চলাকালে আঘাতপ্রাপ্ত পাই। ব্যান্ডেজ পায়েই মিছিল চালিয়ে যাই বলেন খন্দকার রুবাইয়া।
যশোরের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। এবং মিছিলের অগ্রভাগে থেকে তাদের শ্লোগান দিতে ও লাঠিসোঁটা হাতে যুদ্ধংদেহি হয়ে উঠতে দেখা যায়। এটা কীভাবে সম্ভব হলো- এমন প্রশ্নে জুলাই আন্দোলনের সংগঠক ও যোদ্ধা রুবাইয়া জানান, মেয়েরা যখন দেখলো তাদের ভাইয়েরা নির্বিচারে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের গুন্ডাদের কাছে মার খাচ্ছে; তখন তারা দলে দলে মাঠে নামতে শুরু করে। তাদের ভাইদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে থাকে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে রংপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সবার মনে গভীর রেখাপাত ঘটায়। ‘ব্লাঙ্ক-রেঞ্জ পয়েন্ট (খুব কাছের লক্ষ্য যাকে বন্দুক তা না করেও গুলি করা যায়) নিরস্ত্র এক আন্দোলনকারীকে ফ্যাসিস্টের নির্মম বুলেটে হত্যার দৃশ্য সবাইকে প্রথমত নির্বাক করে দিলেও ক্ষোভের আগুনে জ¦লে ওঠে সবাই। সেদিনের সেই ঘটনায় সবাই যেন মিছিলে ও শ্লোগানে একেকজন আবু সাঈদ হয়ে উঠতে থাকেন। আমার কাছে মনে হয় ওই ঘটনাটি সেদিন দেশের সব গণতন্ত্রকামী মানুষকে এককাতারে নিয়ে এসেছিল। সবাই মৃতুভয়হীন হয়ে উঠেছিল সেই বীরত্বপূর্ণ শহীদি আত্মদানের দৃশ্য দেখে।
রুবাইয়া বলেন, আন্দোলনে নানাভাবে বাধা এসেছে। আমাদের ছেলেদের ডিবি পুলিশ ও ডিজিএফআই তুলে নিয়ে গেছে। আন্দোলনে অংশ নিলে গুমের হুমকি দিয়েছে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মেয়েদের মেস-হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। সবাই চলে গেলে একা একা মেসে থেকে আন্দোলন চালিয়ে গেছি। পরে মেয়েরা আবারো ফিরে এসে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। বাড়ি থেকে অনেক সময় নিষেধ করেছে মিছিলে যেতে। সেই নিষেধ শুনিনি। আন্দোলনে চলে গেছি। মিছিলে যাওয়ার আগে ও আন্দোলনের মাঠে থাকাবস্থায় ফোন বন্ধ করে রেখেছি। যাতে বাবা-মায়ের বাধার মুখে পড়তে না হয়। তবে আন্দোলনের একপর্যায়ে কারোর বাবা-মায়েরা আর নিষেধ করেননি।
রুবাইয়া মনে করে শত বাধা বিপত্তির মধ্যেও জুলাই আন্দোলনে এক যুগান্তকারী নারী জাগরণ হয়েছিল। যার কারণে আন্দোলনটি দ্রুত পরিণতি পায়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীরা কোনো সুবিধার মোহে অংশ নেননি। তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে নারীদের সেভাবে আর মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।
তিনি আরো মনে করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান এখনো চলমান। বৈষম্যহীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে আরো অনেক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ঘোষিত ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কাঠামো নির্মূলের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল; সেটি বাস্তবায়নে লড়ে যেতে হবে এখনো আরো অনেক পথ।