
নড়াইল জেলা সদর থেকে মাইজপাড়া সড়কে পাঁচ কিলোমিটার যেতেই রাস্তার পার্শ্বে একটি আধাপাকা ঘরের টিনের ছাউনি বড় ঘর ও চাতাল দেখলে দূর থেকে মনে হয় কোন একটি বড় মিল-কারখানা। সামনে এগোতে টাঙানো আছে একটি সাইনবোর্ডে। সেখানে লেখা আছে ‘মেসার্স ব্রাদার্স ফ্লাওয়ার মিলস’। তবে অন্য আরও কয়েকদিনের মতো গতকালও মিলটির দরজা বন্ধ থাকতে দেখা গেলো।
পিচঢালা রাস্তার গা ঘেঁষে প্রবাহিত একটি সরু খালের ওপারে মিলটির অবস্থান। ফলে মিলে যানবাহন প্রবেশের সরাসরি ব্যবস্থা না থাকলেও, খালের উপর পাটাতন দিয়ে হেঁটে চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন মিল কর্তৃপক্ষ।
প্রতিনিয়ত দরজা বন্ধ থাকার কৌতূহল কাটাতে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেলো, ‘বাস্তবে দিনের অধিকাংশ সময় মিলটি বন্ধ থাকে, মাঝে-মধ্যে সারাদিনেও কেউ মিলে আসেন না। খুলনার বাসিন্দা কোন এক মালিক মিলটি স্থাপন করেছেন’। অন্য মিল-কারখানার মতো এখানে নেই কর্মব্যস্ততা। চোখে পড়ে না, শ্রমিকদের আসা-যাওয়া। তবে, মিলের পার্শ্ববর্তী স্থানে বাড়ি এক ব্যক্তি দাবি করলেন, ‘তারা নিয়মিত না আসলেও, মাঝে-মধ্যে সকালে মিল মালিকের লোকজন আসেন। এক দরজা খুলে ভিতরে পার্শ্ববর্তী মিল চালু করে যান। কিছু মালও আনলোড করে ভিতরে রাখেন, আবার পরে নিয়ে যান। তবে, এই মিল কীভাবে টিকে আছে বা বাণিজ্যিক বিষয়ে কোন ধারণা দিতে পারলেন না স্থানীয়রা।
পরে মিলটি সম্পর্কে অনুসন্ধানে জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেলো, ‘কাগজপত্র মোতাবেক মিলটি সম্পূর্ণ চালু আছে, সেখানে প্রতিমাসে সরকারি গম পেষাই করে আটা উৎপাদনের জন্য নিয়মিত বরাদ্দ দেওয়া হয়। খাদ্য কর্মকর্তারাও সরকারি নির্দেশ মোতাবেক মাঝে-মধ্যে মিলটি পরিদর্শন করে সবকিছু ঠিকঠাক পান।’ সেখানে উৎপাদিত আটার মানও নিশ্চই ভালো, সে- কারণে প্রতিমাসেই ওই মিলে গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এবং ওই গম পেষাই করে আটা উৎপাদনের জন্য সরকারি নিয়ম মেনে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় মিলটিকে। যদিও এসব কিছু জেলা খাদ্য বিভাগের কাগজপত্রের তথ্য, আর এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধান সম্পূর্ণ বিপরীত।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত জুন মাসে নড়াইল পৌরসভায় ওএমএস খাতে আটা বিতরণের লক্ষ্যে উপ বরাদ্দ হিসেবে ১২৫ মেট্রিক টন, জুলাই মাসে নড়াইল পৌরসভায় ওএমএস খাতে ১৭১ মেট্রিকটন, সেপ্টেম্বর মাসে নড়াইল পৌরসভায় ওএমএস খাতে ১৬৫ মেট্রিক টন ও একই মাসে জেলার লোহাগড়া ও কালিয়া পৌরসভায় ওএমএস খাতে ৫৭.২০০ মেট্রিকটন গম বরাদ্দ দেয় খাদ্য অধিদপ্তর।
পরে নড়াইল জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা আফরোজ বরাদ্দকৃত গম বরাদ্দকৃত করে আটা উৎপাদনের জন্য পৃথক অফিস আদেশে সদর উপজেলার উজিরপুর এলাকার ‘নড়াইল অটো ফ্লাওয়ার মিলকে’ ২৬৩ মেট্রিকটন ও সদর উপজেলার গাড়ুচোড়া এলাকার ‘মেসার্স ব্রাসার্স ফ্লাওয়ার মিলকে’ ২৫৫.১৭২ মেট্রিকটন মাড়াইয়ের কার্যাদেশ দেন। সরকারি বিধি অনুসারে ওই গমের ফলিত আটা হিসেবে ৭৭ শতাংশ আটা বুঝে নেয় খাদ্য বিভাগ। তেমনি, গমের বাকি ২৩ শতাংশ ভুসি ও উপজাত পণ্য মিল মালিক পেয়েছেন। এছাড়াও মিল পরিচালনা ব্যয় বাবদ মিল মালিকরা সরকারের কাছ থেকে ১৯ টাকা দরে গম কিনে তা পিষাইয়ের পরে সাড়ে ২১ টাকা দরে ওএমএস ডিলারদের কাছে বিক্রি করেন। এতে প্রতি কেজিতে সরকার বিধি মোতাবেক আড়াই টাকা পেয়ে থাকেন। সে হিসেবে শুধু এই দুইমাসেই মিলটি লাভ আয় করেছে ৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, এছাড়া বরাদ্দকৃত গমের ২৩ শতাংশ ভুসি ও উপজাত হিসেবে রেখে দিয়েছেন।
খাদ্য বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, ‘অচল মিলের মালিকরা খাদ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টদের মাসোহারা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামে গমের বরাদ্দ নেন। মূলত, বিদেশ থেকে সরকারি আমদানি করা উন্নত মানের ওই গম দেশীয় বাজারে চাহিদা থাকায় তা উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে অল্প দরে তুলনামূলক বরাদ্দ আটা কিনে খাদ্য বিভাগকে বুঝে দেয়। এতে পেষাই খরচ বাবদ প্রতি কেজিতে আড়াই টাকা, ২৩ শতাংশ ভুসি ও উপজাত কেটে নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি গম উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে চারদিক থেকে অর্থ আয় করেন ওইসব ভুইফোঁড় মিল মালিকরা। এতে সরকারি উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ায় ভালো মানের আটা থেকে বঞ্চিত হন সরকারি সুবিধাভোগী নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। কোন কোন সময় ওএমএস ডিলারের আটার মান খারাপ হওয়ায় তা খাওয়ার অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। যার দুর্নাম পড়ে খাদ্য বিভাগ ও সরকার সংশ্লিষ্টদের উপর।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মেসার্স ব্রাসার্স ফ্লাওয়ার মিলের মালিক ফারুক হোসেনের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে নড়াইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা আফরোজা বলেন, ‘মিলটি অচল এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমি নিজে মিলটি পরিদর্শন করেছি, তখন আমাদের সামনেই মিল চালু করে এক ঘণ্টার মিলিং ক্যাপাসিটি দেখিয়েছেন। এরপর ওই মিল নজরে রাখতে আমি উপজেলা ফুড অফিসার, টেকনিক্যাল ইন্সপেক্টর ও সদর গুদাম কর্মকর্তাকে নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করে দিয়েছি। তাদের প্রত্যয়নের উপর ভিত্তি করে, আমি সেখানে বরাদ্দ দিই।’
মিলের মাসিক বিদ্যুৎ বিল অনেক কম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে মিল মালিককে আমরাও প্রশ্ন করেছিলাম, উনি জানিয়েছেন তিনি বাইরে কোথাও আটা সাপ্লাই করেন না, শুধু সরকারি বরাদ্দের গম মাড়াই করে সাপ্লাই দেন। এ কারণে সবসময় মিলটি খোলা থাকে না, সকালে প্রয়োজন অনুযায়ী এক-দুই ঘণ্টা চালু করে বন্ধ করেন। এজন্য বিদ্যুৎ বিলও কিছুটা কম আসে।’
এছাড়া অন্য মিলের তুলনায় এই মিলের মোটর ক্যাপাসিটি কম, এ কারণেও বিদ্যুৎ বিল কম আসে। সবমিলিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো বিষয় নেই বলে দাবি করেন।