
ইরান ও ইসরাইল- দুই আঞ্চলিক শক্তি, দুই বিপরীত আদর্শ, দুই বিপরীত শত্রুতা। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এক সময়ের মিত্রতা রূপ নেয় শত্রুতা ও সংঘাতের ইতিহাসে। এই বৈরিতা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্যেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
২০২৫ সালের জুনে যখন উভয় দেশের মধ্যে ১২ দিনের সরাসরি যুদ্ধ বেধে যায়, তখন তা ছিল শুধু সামরিক সংঘর্ষ নয়—একটি আদর্শিক যুদ্ধের বিস্ফোরণ। যদিও মার্কিন মধ্যস্থতায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, কিন্তু উভয় পক্ষের কৌশলগত প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের ভূমিকায় স্পষ্ট, এই বিরতি যেকোনো মুহূর্তে আবার রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরাইলের দ্বন্দ্ব শুধু দুই রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, বরং দুটি ভিন্ন আদর্শ ও নিরাপত্তা দর্শনের সংঘাত। ইরান নিজেকে মুসলিম উম্মাহর রক্ষক এবং ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের ধারক বলে মনে করে; অন্যদিকে ইসরাইল নিজেকে একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই শত্রুতা ২০২৫ সালের জুন মাসে এক নজিরবিহীন অবস্থানে পৌঁছায়, যখন উভয় দেশের মধ্যে সরাসরি ১২ দিনের সামরিক সংঘর্ষ ঘটে।
ইরানের নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরাইল যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তা যেন এক অস্থায়ী বিরতি মাত্র—পর্দার পেছনে এখনও চলছে শক্তি সঞ্চয়ের প্রস্তুতি এবং কৌশলগত অবস্থান মজবুত করার লড়াই।
অতীতের বন্ধুতা, আজকের সংঘাত
ইরানের তৎকালীন রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে ইসরাইল ছিল তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তেল সরবরাহ, গোয়েন্দা সহযোগিতা, এমনকি কুর্দি বিদ্রোহীদের সহায়তায়ও ছিল যৌথ অংশগ্রহণ। ১৯৬৮ সালে গোপনে নির্মিত এইলাত-অ্যাশকেলন পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইসরাইলে তেল সরবরাহ করা হতো। এ সময় ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক এবং ইসরাইলের মোসাদ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করত। দু’দেশই ছিল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং আরববিরোধী অবস্থানে ঐক্যবদ্ধ।
ইসলামি বিপ্লবের পর সম্পর্ক ছিন্ন
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরপরই ইরান নিজেকে মুসলিম উম্মাহ ও মজলুম জাতির পক্ষের শক্তি হিসেবে ঘোষণা করে। ইসরাইলকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘অবৈধ রাষ্ট্র’ ও ‘শয়তানের দালাল’। তেহরানে ইসরাইলি দূতাবাস বন্ধ করে সেখানে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এরপর থেকে ইরান শুরু করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের—বিশেষ করে হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইয়েমেনি হুতিদের—পৃষ্ঠপোষকতা। সিরিয়ার বাশার সরকারকেও সমর্থন দিয়ে গড়ে তোলে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ফ্রন্ট, যা ইসরাইলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে ওঠে।
ইসরাইলের আগ্রাসন ও প্রতিশোধের পর্ব
ইসরাইল বহুবার সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের সামরিক অবস্থানে হামলা চালিয়েছে। মোসাদের মাধ্যমে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার পাশাপাশি, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকেও তেহরানে হত্যার করেছে। ২০২৪ সালে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা তেহরানকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এর জবাবে আইআরজিসি (ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী) ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’ চালায়। তেল আবিবের মানবতাবিরোধী অপরাধযজ্ঞের প্রতিশোধ নিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবরে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’ নামে দুটি অভিযান চালায় ইসরাইলে। এরপর দু’দেশের উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে ১৩ জুন শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
১২ দিনের যুদ্ধ : যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের দম্ভ চূর্ণ
১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন নিয়ে ইরানের ভূখণ্ডে ইসরাইল আকস্মিক হামলা চালায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রও এতে সরাসরি অংশ নেয়। ইসরাইলি আগ্রাসনে ইরানের বেসামরিক নাগরিক, সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীরা নিহত হন। এর জবাবে ইরান সরাসরি তেলআবিব, হাইফা এবং কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে শক্তিশালী পালটা আঘাত হানে। ২৪ জুনের মধ্যে, ইরানের সমন্বিত সামরিক অভিযান ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন কার্যত থামিয়ে দেয়। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ব্যাপকতা ও নির্ভুলতা ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে, বিস্মিত করে দেয়।
অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
যুদ্ধ শেষে একটি ‘সক্রিয় যুদ্ধবিরতি’ কার্যকর হলেও, দুই দেশই আবার সংঘর্ষে জড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইরান শক্তিশালী করছে তার আকাশ প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা ব্যবস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি; অন্যদিকে, ইসরাইল আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আপগ্রেড করছে।
ইরানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আহমাদ জিদআবাদি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইরান বর্তমানে চারটি চ্যানেলের মাধ্যমে আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দ্রুত কোনো পরিবর্তন না এলে, সংঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার বিকল্প কোনো শক্তিশালী ‘অল্টারনেটিভ’ এখনো গড়ে ওঠেনি। প্রবাসী বিরোধী দলগুলো দিয়ে ইরান পরিচালনা সম্ভব নয়, বরং তা নতুন সংকট সৃষ্টি করবে। বিভাজনের রাজনীতি চালালে ইরান দীর্ঘমেয়াদে অস্থির হয়ে উঠবে।’
ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা ও শান্তির বাধা
ইরান-ইসরাইল সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখার পেছনে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর ভূমিকাই মুখ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের দ্বন্দ্বকে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন ক্রমশ এই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় এক শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের নিরাপত্তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নতুন নিষেধাজ্ঞা, উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (যেমন আয়রন ডোম), এমনকি সীমিত সামরিক অভিযান—সবই তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টির অংশ। রাশিয়া, ইরানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মিত্র হিসেবে জাতিসংঘে ভেটো, অস্ত্র সহায়তা বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, চীন ইরানের অন্যতম বড় তেল ক্রেতা ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অংশীদার ২৫ বছরের কৌশলগত চুক্তি, বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্প এবং সম্প্রতি আলোচিত জে-১০সি যুদ্ধবিমান চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। জাতিসংঘে ইরানের পক্ষে অবস্থান এবং ইরান-সৌদি পুনর্মিলনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও চীন ইতোমধ্যে গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠেছে।
ফলে, মধ্যপ্রাচ্য এখন এক ত্রিমাত্রিক ভূরাজনৈতিক দাবার ছক যুক্তরাষ্ট্র চায় ইসরাইল-আরব জোটকে সম্প্রসারিত করতে, রাশিয়া ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’ এর মাধ্যমে প্রভাব বজায় রাখতে, আর চীন চায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে।
তবে, যতদিন না ফিলিস্তিন সংকটের ন্যায্য ও স্থায়ী সমাধান এবং চীন-রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ন্যূনতম আঞ্চলিক সমঝোতা গড়ে ওঠে, ততদিন এই সংঘাতের স্থায়ী অবসান সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক বা সহনীয় পর্যায়ে ফিরবে না।
চূড়ান্তভাবে, এই সংঘাত নিরসনের পথ রচিত হতে পারে কেবল একটি সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে, যাতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সকল পক্ষ এবং অবশ্যই ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার সরাসরি স্বীকৃত হয়। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত, এই সংঘাত রয়ে যাবে এক ‘অস্থির আগুনের নিচে জমে থাকা বারুদ’-এর মতো যে কোনো সময় আবার দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারে।
লেখক : রেডিও তেহরানের সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক