
আধুনিক সভ্যতায় দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নে সঠিক তথ্য এক বিরাট প্রভাবশালী উপাদান। কারণ একজন নাগরিক সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে না পেলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ ব্যতীত রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগই চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে না। এ মহতী লক্ষ্যটি সামনে রেখে বাংলাদেশে ২০০৯ সনে তথ্য অধিকার আইন প্রবর্তিত হয়।
নিজের/ নিজেদের উন্নতির পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তি সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায়। শুধু মানুষের মধ্যে কেন, সকল জীব ও অনুজীবের মধ্যে এহেন প্রবণতা রয়েছে। তবে মানুষের উন্নয়ন প্রচেষ্টা নানা ধরনের জটিল সমীকরণে আবদ্ধ, যা অতি সহজে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তারপরও মানুষ বসে নেই, যার যার মত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস থেকে মানুষ কখনো সরে যায় নি। কিন্তু পরিশেষে আমরা দেখতে পাই, সমাজের নানা গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই বিশাল প্রভেদ; কোন কোন জনগোষ্ঠীর লোকজন উদয়াস্ত অমানবিক পরিশ্রম করেও নিজেদের অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দলিত ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং বিশেষত নারীদের কথা এখানে জ্বাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। বিশ্বের নানা দেশে এরূপ জনগোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে, যাদেরকে সাধারণত পিছিয়ে থাকা, প্রান্তিক, অধিকারবঞ্চিত প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত করা হয়। এসব জনগোষ্ঠীর লোকজন ওপরে বর্ণিত তথ্য অধিকার আইনকে নিজেেেদর উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে।
মিনা বিশ্ব্সা (২৮)। যশোরের কায়পুত্র জনগোষ্ঠীর মেয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাষ্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী অর্জনের মাধ্যমে এলাকায় চমক সৃষ্টি করেছে, কারণ কায়পুত্রপাড়ায় সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়েই লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু চমকের শেষ এখানেই নয়। মা লিলি বিশ্বাসের হাতে গণগবেষণা ও তথ্য অধিকার চর্চায় দীক্ষিত মিনা এখন এলাকার উন্নয়ন উদ্যোগের এক অনন্য মডেল। লিলি বিশ্বাস রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (রিইব) নামক একটি আত্ম উন্নয়ন ভিত্তিক সেবা সংস্থার কর্মী হিসেবেই নিজেকে সমাজে তুলে ধরেন, যিনি পরিবার, প্রতিবেশ, পরিস্থিতি- সব কিছুকে সামাল দিয়ে সমাজের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রিইব-এর দাষিত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় গবেষক হিরণ লাল সরকার মিনার তথ্য অধিকারের চর্চার প্রতি ঝোঁক দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে কর্ম এলাকার অধিকাংশ তথ্য আবেদনের লেখক বা পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন মিনা বিশ্বাস, যখন তিনি কেবল স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
স্বতন্ত্রভাবে মিনার তথ্য অধিকার চর্চার কাজ শুরু হয় ২০২১ সনে রিইব-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত তিনি পাঁচ শতাধিক তথ্য আবেদন করিয়েছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাকে। নিজে তথ্য আবেদন করেছেন একশোর কাছাকাছি।
তথ্য আবেদনের প্রধান বিষয়বস্তু স্থির করতে গিয়ে মিনা দেখলেন, কায়পুত্রসহ যাদেরকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন, তাদের মূল সমস্যাগুলো কি আর কি উপায়ে এসব সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে আসা যেতে পারে। তার বিবেচনায় এল, সরকারের সামাজিক পরিষেবায় যুক্ত করতে পারলে সমাজবিচ্ছিন্ন এসব মানুষের অন্তত দাঁড়ানোর মত জায়গাটুকু তৈরী হয়ে যাবে। বলা আবশ্যক যে, সামাজিক পরিষেবায় এসব মানুষের বলতে গেলে কোন অংশগ্রহণ নেই; অথচ এই কর্মসূচীর অধীনে প্রাপ্তব্য সেবাসমূহ মূলত তাদের জন্যই। সেসব সেবা লাভের জন্য তিনি আশ্রয় নেন তথ্য অধিকার আইনের। যার যে সেবা পাওয়ার প্রয়োজন তাকে দিয়ে সে তথ্যই চাইয়ে তথ্য আবেদন করাচ্ছেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ছাত্র-ছাত্রীর উপবৃত্তি, বেকারদের প্রশিক্ষণ, রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার, নিরাপদ পানি, পয়:নিষ্কাশন, খাসজমি বন্দোবস্ত, সমবায় সমিতি গঠন- এক কথায় মানুষের প্রয়োজনের যত জায়গায় সরকারী পরিষেবার সংযুক্তি রয়েছে, সেসব জায়গায়ই তথ্য আবেদন হয়েছে মিনার মাধ্যমে। তার তথ্য অধিকার চর্চার মাধ্যমে যশোর সদর উপজেলার পাঁচ শতাধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ও প্রায় পনেরো হাজার মানুষ পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছেন এসব সেবা গ্রহণ করে। ফতেপুর গ্রামটি জেলা প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত আদর্শ গ্রাম; যার নেপথ্য কুশীলব মিনা বিশ্বাস।
তথ্য আবেদনসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে মিনার আন্তরিকতা দেখে জেলা ও উপজেলার সরকারী কর্মকর্তারা তার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন। তারা বলেছেন, যেকোন প্রয়োজন হলে আবেদনের প্রয়োজন নেই, সরাসরি চলে আসবেন। কাজের আগ্রহ ও একাগ্রতার ফলস্বরূপ যশোর জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘জেলা সম্প্রীতি পরিষদ’-এর সদস্যপদ পেয়েছেন মিনা।
তথ্য আবেদনের পটভূমি সম্পর্কে মিনা বিশ্বাস কলেন, ‘‘শিক্ষা ও উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে অনেক দূরের একটি জনগোষ্ঠীতে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই দেখতে হত অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের হিংসা ও নিন্দা। যার মূল কারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারা ও এ থেকে উৎসারিত নানা সামাজিক সমস্যা। তখন থেকেই মনে জেদ আসে যে, বড় হয়ে এহেন অবহেলা থেকে নিজের গোষ্ঠীকে তুলে আনার জন্য আমার পক্ষে যা যা করণীয় তা করে যাব। রিইব-এর সাথে বলতে গেলে আমার নাড়ির সম্পর্ক; মা এই সংস্থার সাথে কাজ করতেন, আমাদের উঠানে বসত গণগবেষণার সভা ও তথ্য আবেদন লেখার কাজ। অধিকাংশ আবেদন আমি লিখে দিতাম, খুব ভাল লাগত। ভাবতাম, যদি কখনো এরূপ কাজের সুযোগ আসে তাহলে ঝাঁপিয়ে পড়ব। বর্তমানে সে সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে সাধ্যমত চেষ্টা করছি।” তথ্য অধিকার চর্চার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে মিনার কথা: ‘‘তথ্য অধিকার আইন একটি যুগান্তকারী আইন, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে সরকারের সেবা দানকারী শাখা-উপশাখাগুলোর একটি কার্যকর সম্পর্ক সৃষ্টি হতে চলেছে। এই আইনকে ঘরে ঘরে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য বেসরকারী সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সরকারের একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক, যাতে করে যেকোন নাগরিক যেকোন তথ্য পেতে কোন প্রকার ইতস্তত বোধ না করে।”
তথ্য আবেদন করতে গিয়ে কোন বাধা বা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন কিনা, জানতে চাইলে মিনা বলেন, ‘‘কাজ করতে গেলে কখনো কখনো বাধা আসতেই পারে। এসব বাধাকে অধিক গুরুত্ব দিলে আসল কাজই স্তব্ধ হয়ে পড়বে।” তিনি তার বক্তব্যে আরোও বলেন, “বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করলে তথ্য অধিকারের মত জীবনমুখী আইনটি বিগত দেড় দশকেরও বেশী সময়ে আরোও সুসংহত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখছি যে, এটি সর্বস্তরে সেভাবে চর্চা করা হচ্ছে না। এর কারণগুলোও তথ্য কমিশন উদঘাটন করতে পারেন।” বর্তমানে মিনার অণুপ্রেরণায় তার কর্ম এলাকায় আরোও ক’জন তথ্যকর্মী তৈরী হয়ে গেছেন, যারা কোন প্রয়োজন বা ইস্যু পেলেই তথ্য আবেদনের আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মিনা বিশ্বাস স্বপ্ন দেখেন সে সমাজের, যেখানে হাজারো পার্থক্য থাকা সত্তেও মানুষের অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য থাকবে না; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সৃষ্টির মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সর্বস্তরে তথ্য অধিকার আইনের চর্চা এক্ষেত্রে অনন্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য তথ্য অধিকার আইনের প্রচারণাকে আরোও জোরদার করা প্রয়োজন। আইনটির চর্চায় মাঠকেন্দ্রীক সমস্যা, সম্ভাবনা, সফলতা, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা প্রভৃতি নিয়ে একটি নিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশের কথা ভাবা যেতে পারে।