শনিবার ০১ নভেম্বর ২০২৫

১৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গণভোট প্রশ্নে একদিকে বিএনপি অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি

রানার ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:০৭, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ১৭:০৭, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

গণভোট প্রশ্নে একদিকে বিএনপি অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর। বিএনপি জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করার বিষয়ে অনড়। জামায়াতে ইসলামী চায় নভেম্বরে গণভোট। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সুনির্দিষ্ট সময় না বললেও সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরকারকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারির সুপারিশ করেছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, আদেশের ওপর গণভোট হবে। গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে আগামী নির্বাচনে দ্বৈত ভূমিকার সংসদ গঠিত হবে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত হবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে কন্সটিটুয়েন্ট পাওয়ার (গাঠনিক ক্ষমতা) সম্পন্ন সংবিধান সংস্কার পরিষদ।

এক দিনে দুই ভোট দাবি বিএনপির
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হবে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের আগে গণভোট– এটির সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। এ ব্যাপারে আর আলোচনা করার সুযোগ নেই।

গতকাল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের যুগ্ম মহাসচিব হুমায়ুন কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল উপস্থিত ছিলেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে আমীর খসরু বলেন, কারা কী সুপারিশ করেছে, জানি না। যারা সুপারিশ করেছে, তারা নির্বাচন করবে না; করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। অনেকে অনেক কিছু সুপারিশ করতে পারে। আমাদেরও অনেক সুপারিশ ছিল, যেগুলো ঐকমত্যে আসেনি। ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে কে কী বলছে, কে কী সুপারিশ করছে, এটি তাদের ব্যাপার। ঐকমত্যের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সারাহ কুকের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড, বিএনপির প্রস্তুতি এবং নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু। বৈঠকে এ বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানান তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদল’ দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে এ বিএনপি নেতা বলেন, বর্তমান সরকারের ভেতরে যে কিছু কিছু লোক আছে, যারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শুধু বিএনপির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। 

এ ছাড়া বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরত আসা, বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যপরিধির বিষয় আলোচনায় ছিল বলে জানিয়েছেন আমীর খসরু।

অনৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে ঐকমত্য কমিশন: সালাহউদ্দিন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন বলেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেই সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ৮৪টি দফা সম্ভবত, সেখানে বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্নমত আছে; নোট অব ডিসেন্ট আছে। পরিষ্কারভাবে সেখানে উল্লেখ করা আছে, এসব নোট অব ডিসেন্টের বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো যারা দিয়েছে, তারা যদি নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তারা সেভাবে সেটি বাস্তবায়ন করতে পারবে। সেটি এই প্রিন্টেড জাতীয় জুলাই সনদের যে বই এখানে আপনারা পাবেন, সব দফায় দফায় যেখানে যেখানে ডিসেন্ট আছে, সেখানে আছে। অথচ বিস্ময়করভাবে আজকে (মঙ্গলবার) যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সঙ্গে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে একটা আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। যেটি আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনও টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি।’

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। দ্বিতীয়বার ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এবার ধন্যবাদ দিচ্ছি, কারণ তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত তো হয়নি। পিআরের প্রস্তাব তারা সরাসরি সুপারিশ করে ফেললেন, নোট অব ডিসেন্ট বিষয়টি উল্লেখ ছাড়াই।’
বিএনপির এ নেতার মতে, প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নে ২৭০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। না হলে সংবিধানে তা অটো গৃহীত হবে– এটি হাস্যকর! পরীক্ষায় অটো পাসের মতো সংবিধানে কোনো কিছু সংযুক্ত হতে পারে না; বরং সংসদে যথাযথভাবে পাস হয়ে স্পিকার ও রাষ্ট্রপতির সই হওয়ার পরেই তা আইনে পরিণত হয়। 

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই কিছু সুপারিশ দিয়ে কার্যক্রম সমাপ্ত করতে চেয়েছে। আমরা আশা করছি, উপদেষ্টা পরিষদ ও সরকার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করবে এবং সাংবিধানিক ভিত্তি থাকবে এমন প্রক্রিয়া গ্রহণ করবে। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বিষয়ে গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি সম্মতি দেয়, পরবর্তী সংসদ তা বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবে।

নভেম্বরে গণভোট চায় জামায়াত
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট নয় জামায়াতে ইসলামী। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, সুপারিশে গণভোটের সময়সূচি নেই। জামায়াতের দাবি– নভেম্বরেই গণভোট করতে হবে। 

তিনি বলেন, সুপারিশে বলা হয়নি, আদেশ কে জারি করবে। জামায়াতের অবস্থান হলো, আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়; আদেশ জারি করতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে, যা সুপারিশে নেই।

কমিশন সুপারিশে জানিয়েছে, আদেশ কে জারি করবে, তা সরকার ঠিক করবে। আদেশ জারির পর থেকে আগামী নির্বাচনের দিন পর্যন্ত, যে কোনো সময়ে গণভোট হতে পারে। সরকার সময় নির্ধারণ করবে। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, গণভোটে সংস্কারের ফয়সালা করে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। নভেম্বরের মধ্যে গণভোট করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল ঘোষণা করেও ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন সম্ভব। জামায়াত একেই যৌক্তিক মনে করে। 

কমিশনের প্রথম সুপারিশে বলা হয়েছে, আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করে রেখে যাওয়া সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল পাস হলে গণ্য হবে। সুপারিশে যুক্ত আদেশের দ্বিতীয় খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘পরিষদ ২৭০ দিনে জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করবে।’ হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, জামায়াত প্রথম পদ্ধতিকেই সমর্থন করে। জুলাই সনদে রয়েছে, সেভাবেই সংস্কার করতে হবে।

১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আদেশের খসড়ায় তা নেই। আদেশে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ সংবিধান সংক্রান্ত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  ১৪(২) দফায় বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার সম্পন্নের ৪৫ দিনের মধ্যে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাত পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, এ সুপারিশ গ্রহণযোগ্য নয়। নভেম্বরে গণভোট করে একই সঙ্গে সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে করতে হবে।

নির্বাচনের আগে গণভোট চায় এনসিপি
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে সুপারিশে সরকার উল্লেখ থাকলেও তাদের প্রত্যাশা, প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে জুলাই জাতীয় সনদের আদেশ জারি হবে। তবে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) কার্যকারিতা না রাখার বিষয়ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছে দলটি। ফলে আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন দলের নেতারা। এনসিপি নেতারা বলেন, নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তা দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে এবং জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেবে। তবে সুপারিশে সরকার উল্লেখ থাকলেও জুলাই জাতীয় সনদের আদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জারি করতে হবে। দু-এক দিনের মধ্যেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সমকালকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আদেশটা কে জারি করবেন– সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর কার্যকারিতা না রাখা এবং ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ ভোটের মাধ্যমে গণভোটের বিধান রাখাটা আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। জুলাই সনদ স্বাক্ষর বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 

আরেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, প্রাথমিকভাবে এসব সুপারিশকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। বিশেষ করে ৯ মাসের মধ্যে সংস্কার না হলে জুলাই সনদ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। 

এদিকে গতকাল রাজশাহী নগরীর পর্যটন মোটেলে এনসিপি উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কিছু ভাষাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, গণভোট নির্বাচনের আগে হলে দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়

শীর্ষ সংবাদ: