শনিবার ০১ নভেম্বর ২০২৫

১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মহিষাসুর বধ-এর তত্ত্বকথা

স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ

প্রকাশিত: ১৮:৪৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৮:৫১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মহিষাসুর বধ-এর তত্ত্বকথা

পৌরাণিক উপাখ্যানে দেখা যায়- দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। এখন এই মহিষাসুরের পরিচয় সম্বন্ধে আমাদের অনেকের জানা নেই। প্রকৃত পক্ষে মহিষ হলো- একপ্রকার পশুর নাম। আর অসুর কথার অর্থ সুর-বিরোধী। যে দেব-দেবী কিছুই মানে না। শক্তি আছে কিন্তু তা অসৎ পথে পরিচালিত। পুরাণে রম্ভাসুরের পুত্র- তিনি ঘোরতর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে বলীয়ান এক অসুর। যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মায়াজাল বিস্তার করে বিভিন্ন রকম ভয়ংকর রূপ ধরে দেবী দুর্গার সাথে যুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন রূপের মধ্যে তিনি মহিষের রূপ ধারণ করে দেবীকে আক্রমণ করেছিলেন। একাধারেই মহিষ এবং অসুর। তাই এর নাম মহিষাসুর।
একাধারেই পশুর গুণাবলি আর অসুরের গুণাবলি বিদ্যমান। পশুর গুণাবলি হলো আহার, নিদ্রা আর মৈত্থন। অপর দিকে অসুরের গুণাবলি, গীতায় আছে-

                দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ।
                অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্ ॥(১৬/৪)

অর্থাৎ যারা আসুরী অবস্থা লাভ করেছে তাদের মধ্যে দেখা যায় ধর্মধ্বজিত্ব, ধন ও স্বজননিমিত্ত দর্প, অহংকার, ক্রোধ, কর্কশ ব্যবহার, কর্তব্যাকর্তব্য বিষয়ে অবিবেক। আসুরিক এবং পাশবিক এই দুটি ভাব-শক্তিতে বলীয়ান মহিষাসুর। সে দেবী দুর্গাকে বিভিন্ন মায়াজালে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে দশদিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন। তাই দেবী দুর্গাও দশ হাতে যুদ্ধ করে দুর্দমনীয় মহিষাসুরকে পরাজিত করে।

উপরোক্ত উপাখ্যানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায় দেবতাদের ও অসুরের মধ্যে- সংগ্রাম চিরকালের। যেন সু এবং কু- এর মধ্যে লড়াই। মানবের অন্তরেও দৈবশক্তির সঙ্গে আসুরিক শক্তির লড়াই সর্বদাই লেগে আছে। প্রতিটি মানবের মধ্যে এই মহিষাসুরের গুণাবলি বিদ্যমান। মানব মন তিনটি গুণে গুণান্বিত। তমোগুণ, রজোগুণ এবং সত্ত্বগুণ। দেখা যায় তমোগুণের অধিকারী মানবের মধ্যে পাশবিকতা অর্থাৎ পশুর ভাবগুলো বেশী বিদ্যমান- আহার, নিদ্রা, মৈত্থন এদের সর্বস্ব। আবার রজোগুণ প্রধান মানুষে দেখা যায় তারা কর্মের প্রতি আসক্ত। কিন্তু সে-কর্ম নিষ্কাম নয় সকাম কর্ম যা মানবকে মুক্তির পরিবর্তে বন্ধনের কারণ হয়। আমরা এটি অসুরের মধ্যে দেখতে পাই।
আর সত্ত্বগুণের অধিকারীর মধ্যে দেখা যায় দৈবী শক্তি বা সৎ গুণাবলি। গীতায় ষোড়শ অধ্যায়ে দৈবী সম্পদের কথা বলা হয়েছে-

                অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধির্জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ।
                দানং দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জবম্ ॥ (১৬/১
                অহিংসা সত্যমক্রোধস্ত্যাগঃ শান্তিরপৈশুনম্।
                দয়া ভুতেস্বলোলূপ্তং মার্দবং হ্রীরচাপলম্ ॥ (১৬/২)
                তেজঃ ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা।
                ভবন্তি সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত॥ (১৬/৩)

অর্থাৎ যাঁরা দৈবী সম্পদ লাভ করেছে তাঁদের ভয়শূন্যতা, ব্যবহারকালে পরবঞ্চন ও মিথ্যাকথন- বর্জন, জ্ঞান ও যোগে নিষ্ঠা, সামর্থ্যানুসারে দান, বাহ্যেন্দ্রিয়ের সংযম, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, শান্তি, পরদোষ প্রকাশ না করা, দীনে দয়া, লোভরাহিত্য, মৃদুতা, অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্মে লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ধৈর্য, বাহ্যাভ্যন্তর শৌচ, অবৈরভাব, অনভিমান, ক্ষমা, পরোপকার, নিরহংকারিতা ও ঈশ্বর প্রণিধান। এগুলি হলো দৈব শক্তি। মানব মনে আসুরিক ভাবগুলো এবং পাশবিক ভাবগুলো প্রবল থাকায় দৈবী ভাবগুলো যা সত্ত্বগুণজাত তা প্রকাশিত হতে পারে না। কিন্তু সাধনার মাধ্যমে আসুরিক, পাশবিক ভাবগুলো দূরীভূত করতে পারলে দৈব ভাবগুলোর স্ফুরণ ঘটে। তখনই মানুষ প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়। সে ভগবান লাভের যোগ্য হয়ে মানব জীবন সার্থক করে।

দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেখা যায়- দেবী দুর্গার পদতলে মহিষাসুরের অবস্থান। যুদ্ধের পূর্বে অসুরের ধারণা ছিল দেবী দুর্গা সামান্য অবলা নারী যা কিনা পুরুষের ভোগের বস্তু। কিন্তু মহিষাসুর পরাজিত হয়ে উপলব্ধি করেছেন দেবী দুর্গা নারী হলেও ভোগের বস্তু নয়, অবলা সামান্য নয়, কামনা চরিতার্থ করার জন্য নয়। দেবী দুর্গার ত্রিশূল তার বক্ষে বিদীর্ণ হলে মহিষাসুরের মধ্যে আসুরিক এবং পাশবিক ভাব ত্রিশূলের দ্বারা বিনষ্ট হওয়ায় তার মধ্যে দৈবী ভাবগুলো জেগে উঠেছে। তাই দেবী দুর্গাকে সে জগৎজননী সম্বোধন করে স্তব শুরু করল। মূলত একই মায়ের দুটি সন্তান একটি দেবতা অন্যটি অসুর। মহিষাসুরের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা অসুরকেও নিজ সন্তান জ্ঞান করে তাঁরই পদতলে স্থান দিয়েছেন। শ্রীমা সারদা দেবী বলতেন, সন্তানের যদি ধুলো-কাদা গায়ে লাগে তাতো মা-ই সেই ধুলো ঝেড়ে, কোলে তুলে নেয়। ফলে মহিষাসুর এখন আর অসুর নয়। দেবতার আসনে স্থান লাভ করে ভক্তের নিকট পূজনীয় হলেন।
মানবের মধ্যেও তমোগুণজাত, রজোগুণজাত, পাশবিক আসুরিক ভাবগুলো বিদ্যমান। এগুলো সাধনার মাধ্যমে মানুষ দূর করতে পারলে যোগ্যতা অর্জন করে দেবতার আসনে উন্নীত হতে পারে। যে যত সৎচিন্তা, সৎধ্যান, সৎকাজ করবে ততই তার ভেতর থেকে অসৎ ভাবনা তিরোহত হবে। অর্থাৎ আসুরিক ভাব দূর হবে দৈবী ভাব প্রবল হবে। তখন কাম-ক্রোধাদি হ্রাস পেয়ে তার মধ্যে জাগ্রত হবে জীবের প্রতি ভালবাসা, প্রেম, ক্ষমা, দয়া, পরোপকার, অহিংসা। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি। আনন্দ। যা মানবের কাম্য। ফলে আসুরিক ও পাশবিক সম্পন্ন ব্যক্তিও ক্রমে সৎ মানুষে পরিণত হতে পারে। সমাজের নিকট গ্রহণীয়, আদরণীয়, স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

মহিষাসুর বধে দেবী দুর্গা যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষকে এবং অসুরকে বধ করেন ত্রিশূল রূপ অস্ত্র দিয়ে। মহিষাসুর-এর এই ভাব দুটি মানব মনেও রয়েছে। প্রকৃত পক্ষে অজ্ঞানীরাই নিম্ন স্তরের প্রাণী। তাদের মধ্যে পাশবিক, আসুরিক ভাবই প্রধান। আর তা দূর করতে দেবী প্রয়োগ করলেন জ্ঞানরূপ ত্রিশূলকে। কারণ প্রকৃত জ্ঞান হলে কু-ভাবগুলো দূর হয়ে সু-ভাবে পূর্ণ হয়। অজ্ঞানরূপ ভাবগুলো দূর হয়। সিংহের পিঠে এবং অসুরের দেহে দু’পা সজোরে চেপে রেখে যুদ্ধ করেছেন অসুরের সাথে। মানব মনের পাশবিকতা ও আসুরিকতা দূর করতেও তদ্রƒপ শক্তভাবে মানসিকতা বা পুরুষকার নিয়ে কু-ভাবগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে সৎ ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিতি করতে হবে। এরূপে মানব মনেও দৈবী শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে মানুষ দেব ভাবাপন্ন হতে পারে।

দেবী দুর্গার আরেক নাম- ‘ত্রিনয়নী’। তাঁর তিনটি নয়ন বা চোখ রয়েছে। আমরা দুটো চোখে জাগতিক জ্ঞান লাভ করি। আমাদের তৃতীয় নয়ন নেই, তবে সাধনার মাধ্যমে তা লাভ করা যায়। তৃতীয় নয়ন দ্বারা আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ হয়। দেবী দুর্গা তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে জীবের অজ্ঞানরূপ আসুরিকতা দূর করেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন- হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে দেশলাই জ্বালালে মুহূর্তেই সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়। তদ্রƒপ আমাদের মনের অজ্ঞানতাও। দেবী দুর্গার কৃপায় তাঁর পূজা করে, ধ্যান করে, মনের মলিনতা দূর করে, শুদ্ধতায় ভরে উঠে পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত হতে পারি। সমাজের অসুর শ্রেণির মানবের পরিবর্তন হয়ে সব দেবমানব হবে, সমাজ হবে সত্যযুগের। বিশ্ব হবে আনন্দময়।

লেখক : অধ্যক্ষ রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশন যশোর।
 

শেয়ার করুনঃ

জনপ্রিয়

শীর্ষ সংবাদ: