
বাংলাদেশের পরিচয়ই কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এখনো কোনো না কোনোভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৫৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ কৃষিজমি এখনো উৎপাদনশীল ও টেকসই ব্যবহারের বাইরে। অর্থাৎ, কৃষি খাত তার সম্ভাবনার বড় অংশটাই কাজে লাগাতে পারছে না।
সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি জরিপ ২০২৫’-এর ফলাফল প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে কৃষিখাতের এক গভীর সংকট ও কাঠামোগত দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে।
অব্যবহৃত উৎপাদনশীলতা
জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৪৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ কৃষিজমি টেকসইভাবে ব্যবহৃত হলেও অধিকাংশ জমিই অদক্ষ ব্যবহার, মাটির গুণগত অবনতি, অপ্রতুল প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাবে কাক্সিক্ষত উৎপাদন দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
জমির গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭২ দশমিক ৭৫ শতাংশ কৃষিজমির অন্তত ৫০ শতাংশ অংশে মাটির অবক্ষয় হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন কমিয়ে দেবে। অধিক রাসায়নিক সার, অপরিকল্পিত সেচ ও জমি চাষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অভাবে এই অবক্ষয় ঘটছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
সেচ ও প্রযুক্তি বিভাজন
৮১ দশমিক ৮৬ শতাংশ জমি সেচ সুবিধা পেলেও সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকের সচেতনতার ঘাটতি উদ্বেগজনক। মাত্র ৫৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ কৃষক সার ব্যবহারের জন্য সরকার নির্ধারিত আটটি পদ্ধতির মধ্যে মাত্র দুটি অনুসরণ করছে। কীটনাশক ব্যবহারে টেকসই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করছে মাত্র ৫১ শতাংশ।
জমির মালিকানা ও অর্থনৈতিক চাপ
৯৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ কৃষক পরিবার খাদ্য সংকটে না পড়লেও, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কৃষক কোনো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সুবিধার আওতায় নেই। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজার মূল্য পতন বা উৎপাদন ব্যর্থতা তাদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে।
নিরাপদ কৃষি ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ
সরকার টেকসই কৃষি ব্যবস্থার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা এখনো দুর্বল। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শুধু উৎপাদন বাড়ানো নয়, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষিই আগামী দিনের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
দায়িত্বহীনতা নাকি দৃষ্টিভঙ্গির সংকট?
বাংলাদেশের কৃষি নীতির কাঠামোতে উৎপাদন, বাজারিকরণ, কৃষকের অধিকার, ভূমি সংস্কারÑএমন বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এখনও গুরুত্ব পাচ্ছে না। খাদ্য আমদানিনির্ভরতা ক্রমে বাড়ছে, অথচ দেশের কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ছে।
একটি সামগ্রিক কৃষি বিপ্লব বা নীতিগত পুনর্বিন্যাস ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মত বিশ্লেষকদের। প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও কৃষকবান্ধব একটি কৃষি দর্শন। এর জন্য চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় একটি কমিশন করা উচিত ছিলো বলে মনে করেন তারা।
তারা বলছেন, যেখানে কৃষিই দেশের অর্থনীতি, খাদ্য, কর্মসংস্থান ও সংস্কৃতির মূলভিত্তি, সেখানে কৃষকের ঘামে ভেজা মাটিকে যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরিচয় এক ভয়ংকর প্রশ্নের মুখে পড়বে। এই বাস্তবতা বদলাতে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা এবং কৃষকের পাশে থাকার রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার।