
মৌসুমি জলাবদ্ধতা দূর করা গেলে প্রতিবছর বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে অতিরিক্ত অর্ধশত কোটি টাকার বেশি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট খাতে যুক্ত ব্যক্তিরা এমনটি জানিয়েছেন। সমন্বিত উদ্যোগ, নাগরিক সহযোগিতা ও আইনের বাস্তব প্রয়োগ হলে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে অভিমত দিয়েছেন এই উপজেলার নাগরিক সমাজ।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, বছরের পর বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিপাত, অস্বাভাবিক জোয়ার, নদী-খালের নাব্যতা হ্রাস, অকেজো স্লুইসগেট ও অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক জলপ্রবাহে জাল-পাটা দিয়ে মাছ শিকার এবং ব্যক্তিগত জমিতে থাকা অপরিকল্পিতভাবে তৈরি কালভার্ট বন্ধের কারণে ফকিরহাট উপজেলাটি ভয়াবহ মৌসুমি জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে আসছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক, মাছ চাষি ও সাধারণ মানুষ।
বর্তমানে উপজেলার অধিকাংশ নীচু এলাকা, ধান ও সবজির জমি, মাছের ঘের, পুকুর, বাড়িঘর, স্কুল-মাঠ ও রাস্তাঘাট পানির নিচে। ভাইরাস সংক্রমণ ও জলমগ্নতার কারণে মারা যাচ্ছে বাগদা মাছ। নষ্ট হচ্ছে ধানের বীজতলা, সবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুধু ফসল বা মাছ নয়, তাদের বসতভিটা, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাজার ডুবে থাকায় জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের আরো বেশি সহযোগিতা চান ভুক্তভোগীরা।
মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ফকিরহাটে ২হাজার ৩২৪ টি বাগদা চিংড়ি ঘের, ৫হাজার ৭৭৯ টি গলদা চিংড়ি রয়েছে। এছাড়া সাদা মাছ ও মিশ্র মৎস্য চাষের ঘের রয়েছে। এছাড়াও অর্ধসহস্রাধিক বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের পুকুর রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা ৪৩০টি বাগদা চিংড়ি ঘেরে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। ডুবে গেছে ৬২৫টি চিংড়ি ও দেশি মাছের ঘের। ডুবেছে কয়েকশ পুকুর। ধসে গেছে প্রায় ৩০০ একরের বেশি চিংড়ি ঘেরের জমি। তবে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। মাছ চাষিদের দাবি, এ উপজেলায় জলাবদ্ধতা ও ভাইরাসে বছরে তাদের প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়।
মাছ চাষি শওকত আলী, শেখ মনি, মুরাদুল ইসলাম, বাবু ফকিরসহ বেশ কয়েকজন জানান, কিছুদিন আগে প্রখর রোদ ও তাপে ঘেরে ভাইরাস লেগে মাছ মরেছে। তারপর হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও অস্বাভাবিক উচ্চ জোয়ারের জলাবদ্ধতার কারণে তাদের ঘের ডুবে মাছ ভেসে গেছে। আবার নতুন করে চাষ শুরুর মতো পুঁজি ও পোনাও নেই। ইতোমধ্যে এদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
কৃষি অফিস জানায়, উপজেলার ১০টি স্লুইসগেট মেরামত ও নব্যতা হারানো খালগুলো পুনঃখনন করা গেলে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। এতে অতিরিক্ত ১ হাজার ১৮৮ হেক্টর জমিতে আবাদ করা সম্ভব। এতে বিপুল পরিমাণ ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন হবে, যা উপজেলায় কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারে।
কৃষক রমজান শেখ, সেলিম হাওলাদার, এসএ কালাম, মোস্তফা হাসান, মলয় কুণ্ড, আলমগীর, তৃষ্ণা দাশসহ অনেকে জানান, জলাবদ্ধতার কারণে তাদের সবজি ও আমন ধানের বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে মৌসুমি জলাবদ্ধতায় এই সমস্যা হয়।
একাধিক খামারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, জলাবদ্ধতায় প্রাণিসম্পদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। গো-খাদ্যের সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং দানাদার খাদ্য, যেমন- ভূট্টা, জব জাতীয় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় অসুস্থ হচ্ছে গবাদিপশু।
সমাজকর্মী ও প্রবীণ সাংবাদিক খান মাহমুদ আরিফুল হক আরিফ বলেন, উপজেলায় মৌসুমি জলাবদ্ধতায় বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করলে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। জলাবদ্ধতা সমাধান হলে কৃষিতে প্রায় ১৫ কোটি, মৎস্য খাতে প্রায় ৩০ কোটি এবং প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৫ কোটি টাকা পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তার বক্তব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো একমত পোষণ করে জানান, মৌসুমি জলাবদ্ধতা ফকিরহাটের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতায় এই কয়েক দিনে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। স্লুইস গেট মেরামত করলেই ১০ কোটি টাকার ফসল রক্ষা করা সম্ভব। ভরাট নদী ও খাল খনন করা হলে এর সুফল পুরো উপজেলা পাবে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শেখ আসাদুল্লাহ বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে ঘের থেকে মাছ ভেসে যাচ্ছে, ভাইরাসে মাছ মরছে। তবে আমরা মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জাল পাটা অপসারণ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
ফকিরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমনা আইরিন বলেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। আমরা ধাপে ধাপে সমাধানের চেষ্টা করছি।