
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী নারীদের আন্দোলনের সময়কার নানা স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরছে দৈনিক রানার। ‘ফিরে দেখা দ্রোহের জুলাই’ শীর্ষক এই আয়োজনে জুলাই’র নারী যোদ্ধা রাজিয়া সুলতানা চাঁদনীর সাক্ষাৎকারটি প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরেছেন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক কবি ও অণুগল্পকার মামুন আজাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় নারী শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত মুখ দেখে স্থির থাকতে পারেননি। উপরন্তু শেখ হাসিনার দেওয়া তকমা রাজাকারের নাতিপুতি- ‘জুলাই কন্যা’ রাজিয়া সুলতানা চাঁদনীর টগবগে রক্তে একেবারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ছাত্রদের সাথে মিছিলে দুই সারিতে ১৫/২০ জন ছাত্রী যশোরের রাজপথে নেমে পড়েন। সেই মিছিলে অংশ নেন চাঁদনী। এরপর আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কসাইয়ের দোকানে পর্যন্ত মিটিং করেছেন।
পরিবারের চোখ এড়িয়ে এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যান একদিন। মা তাকে ভীষণ জোরে থাপ্পড় দিয়েছিলেন সেদিন। তারপরও আন্দোলন থেকে সরে যাননি।
সম্প্রতি দৈনিক রানারের সাথে জুলাই আন্দোলন নিয়ে এক আলাপচারিতায় মিলিত হন যশোর সরকারি মাইকেল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী চাঁদনী। আলাপকালে জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
চাঁদনী জানান, প্রথম দিকে মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও চাকরি প্রত্যাশীরা এই আন্দোলন শুরু করলেও পরে স্কুলের ছোট ছোট ভাই-বোনেরাও মাঠে নেমে পড়ে। কারণ, ওদের বড় ভাই-বোনদের ওপর হাসিনার নৃশংসতা সহ্য করতে পারেনি। তিনি জানান, আন্দোলনের একপর্যায়ে রংপুরে আবু সাইদকে গুলি করে হত্যার সেই দৃশ্য সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। আমরাও আন্দোলনে মরণপণ ঝাঁপিয়ে পড়ি।
জুলাই যোদ্ধা চাঁদনী বলেন, যশোরে আন্দোলন চলাকালে আমরা মূলত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলাম বেশি। তবে ৩১ জুলাই পুলিশও লাঠিচার্জ করে। ছাত্রলীগ সেদিন ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা চালায়। এদিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে হামলা করে ছাত্রলীগ। ছুরিকাঘাতে সামিউল ভাইসহ অনেকে আহত হন।
৩১ জুলাই যখন লাঠিচার্জ হল, আমার হাতে প্লাকার্ড দেখে পুলিশ আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলে। কিন্তু আমি বাড়ি না গিয়ে কোর্ট চত্বরের পাশে একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নিই। তখন ৮/১০ জন ছাত্রলীগের গুন্ডা আমাকে বিশ্রীভাবে গালিগালাজসহ হুমকি দেয়- বলেন জানান চাঁদনী।
তিনি বলেন, আবু সাইদ, মীর মুগ্ধসহ অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হলো। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে সাত বছরের শিশুকে মারা হলো। অথচ মানুষের জীবনের চেয়ে হাসিনার কাছে মেট্রোরেল প্রিয় হলো। তখন দেশের মানুষ আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি।
চাঁদনী জানান, জুলাই আন্দোলনে মহিলা কলেজের মেয়েরা হোস্টেলের তালা ভেঙে মিছিলে এসেছিল। পরবর্তীতে হলের প্রভোস্ট ও অন্যান্য শিক্ষকেরা তাদের ওপর মানসিক অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই প্রভোস্টের কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। শাস্তির আওতায় আসেননি। তিনি বলেন, জুলাইয়ের নারীরা এখন প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। এ নিয়ে আমাদের পরিবারসহ আমরা নিজেরাও আতঙ্কিত।
রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে চাঁদনী বলেন, আমাদের আন্দোলন কোটা নিয়ে শুরু হলেও আমরা চেয়েছিলাম বৈষম্যহীন সমাজ। চেয়েছিলাম বৃহত্তর সংস্কার। কিন্তু যেগুলোর তেমন কিছুই হয়নি। খুনিরা অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে; এলাকায় ফিরে আসছে। এসব নিয়ে আমরা হতাশ।
তিনি আরো বলেন, আমরা এসব চুপ করে দেখছি; এর মানে কিন্তু এই না যে, আমরা চুপচাপ বসে থাকবো। আমরা আরেকটা স্বৈরাচারের জন্ম হতে দিতে পারি না। আর তাই আমরা রাজপথ ছাড়বো না। তবে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়, এখন আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছি, সে যেই হোক না কেন।