পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কারসাজির মাধ্যমে ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় সার না পেয়ে হাকাকার করছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও কারসাজির মাধ্যমে ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করায় সার না পেয়ে হাকাকার করছেন ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার পেঁয়াজ চাষিরা। ফলে চাষাবাদের ভরা মৌসুমে সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করতে না পারলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে, কৃষি বিভাগ ও ডিলারদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে সরকারি সার নিয়ে নয়ছয়ের আভাস মিলেছে। আর কৃষকদের ভাষ্য প্রমাণ করছে; অনিয়মের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সার প্রাপ্তি থেকে চাষিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে, গত নভেম্বর মাসের জন্য বরাদ্দ ভর্তুকির ১৫’শ ৪২ টন ডিএপি সারের মধ্যে ৯’শ টন কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এখনো ৬’শ টন ডিএপি সার মজুত রয়েছে। ফলে সারের সংকট নেই।
অন্যদিকে ডিলাররা বলছেন, ডিএপি সার নেই। গত ৬ মাস ধরে সংকট চলছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, বিপুল পরিমাণ সেই সার গেল কোথায়? যার দাম ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার ওপর। প্রতি কেজি ডিএপি ২১ টাকা দরে ১ টনের ( ১ হাজার কেজি বা ২৫ মণ) দাম ২১ হাজার টাকা। এই হিসাবে ৬’শ টনের দাম কোটি ৩২ লাখ টাকা।
কৃষকদের অভিযোগ, বিসিআইসি’র ডিলাররা তাদের পছন্দ মতো আর তদবিরে কৃষকদের সার দিচ্ছেন। ফলে প্রান্তিক চাষিরা ন্যায্যতার ভিত্তিতে সার পাচ্ছেন না। এদিকে ইউনিয়নে ও ওয়ার্ডের সাব ডিলারদের অভিযোগ, সরকারি বরাদ্দের সার তাদের দিচ্ছেন না ডিলাররা। ফলে সংকট আরো বেড়েছে। প্রান্তিক চাষিরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। কৃষকরা বলছেন, বিসিআইসি’র সার ডিলার ও কৃষি অফিসের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শৈলকুপা উপজেলায় গত মৌসুমে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয়। এবার প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ও সম্ভাবনা রয়েছে।
সাব-ডিলার জাফর হোসেন বলেন, ডিলারদের কাছে ধরনা দিয়েও সার পাচ্ছেন না। কৃষকদের অভিযোগ, সাব-ডিলাররা তাদের সার বিভিন্ন এলাকায় খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে এক হাজার ৫০ টাকা বস্তার ডিএপি কৃষকদের কিনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকার বেশি দামে।
উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে,এখন এই অঞ্চলের কৃষকেরা মাঠের পর মাঠজুড়ে পেঁয়াজ রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছে। মনোহরপুর ইউনিয়নের কৃষকরা বলছেন, তারা চাহিদা অনুযায়ী ডিএপি সার পাচ্ছে না। ফলে পেঁয়াজ ক্ষেতে এখনও সার দিতে পারেননি।
মনোহরপুর গ্রামের কৃষক সিজার মিয়া, আনোয়ার হোসেন, মনোয়ার হোসেন, শহিদুল মিয়া, হুমায়ুন মিয়া, চুকা হোসেন, রপু মিয়া, রহিদুল মিয়া, রিতন জোয়াদ্দার, রিপন হোসেন, আকবর মিয়া, জাফর হোসেনসহ এক গ্রামেরই অর্ধশত কৃষক এখনো তাদের পেঁয়াজের ক্ষেতের জন্য সার পাননি ।
কৃষক শাহীন মিয়া জানান, তার ৫ বিঘার বেশি জমিতে পেঁয়াজ চাষ করছেন। কিন্তু এখনো প্রয়োজনীয় ডিএপি সার দিতে পারেননি। তিনি জানান, নভেম্বর মাসে শৈলকুপায় ১৫’শ ৪২ টন ডিএপি বরাদ্দ ছিল। তার মধ্যে ৯’শ টন বিতরণ করা হয়েছে। ডিলারদের কাছে এখনো ৬’শ টন ডিএপি সার মজুত রয়েছে।
ধলহরাচন্দ্র ইউনিয়নের ডাউটিয়া গ্রামের কৃষক আরিফ মৃধা জানান, সরকার নির্ধারিত মূল্য ছাড়াও অতিরিক্ত দাম দিয়েও সার পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো খুচরা দোকানেও সার নেই। সময়মতো জমিতে সার দিতে না পারলে পেঁয়াজ চাষে ক্ষতি হয়ে যাবে।
বিসিআইসি সার ডিলার সমিতির সভাপতি ও হাকিমপুর ইউনিয়নের সার ডিলার নোমান মোল্লার দাবি, চাহিদা অনুযায়ী ডিলাররা সার পাননি। ফলে এমন সংকট দেখা দিয়েছে।
মনোহরপুর ইউনিয়নের সার ডিলার গোলাম নবী জানান, তার কাছে ৫ টনের মতো ডিএপি সার মজুদ আছে। যা বিতরণ চলছে। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে পেঁয়াজ লাগানোর সময় কৃষকেরা বিঘা প্রতি ২০/২৫ কেজি ডিএপি পাবেন। কিন্তু বস্তা বস্তা ডিএপি দাবি করে কৃষকেরা। এতে করে সংকট বেড়েছে।
কৃষক-ক্ষেতমজুর নেতা সুজন বিপ্লব বলেন, অবিলম্বে দোষীদের ডিলারশিপ বাতিল ও দুর্নীতিবাজ কৃষি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করে কৃষকের পর্যাপ্ত সারসহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিনি বলেন, খুলনা বিভাগের মধ্যে শৈলকুপায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করে কৃষকেরা। মূলত এই সুযোগ নিয়ে চাষিদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে সরকারি সার নিয়ে। এতে উৎপাদন ব্যহত ও চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। দ্রুত এই সংকটের সমাধান না করা হলে লোকসানের ফলে কৃষক পেঁয়াজ চাষ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। শৈলকুপা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান বলছেন, তারা প্রায়ই অসাধু সার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন। ইতোমধ্যে শৈলকূপা ডিলার সমিতির সভাপতিকে কৃষি অফিস থেকে শোকজ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বেশি সার বরাদ্দ রয়েছে শৈলকুপায়। কোনো ডিলার বা সাব-ডিলারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা দ্রুত জানানোর অনুরোধ জানান তিনি। এদিকে অবৈধ সার ডিলার ও মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে বিপুল পরিমাণ সার উদ্ধার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুই ব্যবসায়ীকে অর্ধলক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান, উপজেলা কৃষি বিভাগ ও থানা পুলিশের একটি টিম উপস্থিত ছিল।


























