বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সরকারি সার বিসিআইসি ও বিএডিসি গুদামে পৌঁছানোর আগেই খুলনা ও নওয়াপাড়ার বিভিন্ন ঘাট থেকে চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। কখনো আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আবার কখনো- ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, ট্রাক চালকসহ স্থানীয় সিন্ডিকেট এই অপকর্ম অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে সামান্য পরিমাণ সার জব্দ ও জরিমানা হলেও আমদানীকারকরা দায় চাপায় কর্মচারী, পরিবহণ ঠিকাদার ও ট্রাক চালকের ওপর। আর এই সুযোগে অধরা থাকা লাখ লাখ বস্তা সরকারি সার কালোবাজারে বিক্রি করে সিন্ডিকেটগুলো দেদারে বিরাট অঙ্কের টাকার অবৈধ বাণিজ্য করছে।
এমন পরিস্থির মধ্যে আমদানিকৃত প্রায় ৫ হাজার বস্তা নন-ইউরিয়া সার যশোরের নওয়াপাড়া থেকে ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকার বিএডিসি গুদামে পাঠানোর সময় আত্মসাতের অভিযোগে পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আকিজ রিসোর্স লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের তিন কর্মচারী আটক হয়েছেন।
আটকরা হলেন, চাঁদপুর জেলার শাহারাস্তি উপজেলার বরুলিয়া গ্রামের মৃত মনতোষ মজুমদারের ছেলে সুমন মজুমদার (৩৫), চট্টগ্রাম জেলার খুলশী উপজেলার রেলওয়ে কলোনির দুলাল দাসের বাবুল দাস (৩৬), নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার উইলসন রোডের বাসিন্দা তফিকুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ মাসুম। আটকদের দেওয়া তথ্যে, মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্সে অভিযান চালিয়ে কর্মচারী বাবুলের ডেক্সের ড্রয়ার থেকে ২২ লাখ ২৪ হাজার টাকা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৯ ও ১০ নভেম্বর নওয়াপাড়ার সর্দার জুট মিল ঘাট, মক্কা ঘাট এবং বড়বাড়ি ঘাট থেকে আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ৮৪০ বস্তা সার সাতটি ট্রাকে লোড করে রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী জেলার বিএডিসি গোডাউনের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। ওই সার গন্তব্যে পৌঁছানোর নির্ধারিত তারিখ ছিলো ১২ নভেম্বর। তবে ওই সার গন্তব্যে যায়নি।
এরপর ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বাবুল দাস এবং পবিত্র কুমার কুন্ডু অফিসে মেইল করে জানায়, ওই সার চুুরি করে ট্রাকচালকরা অন্যত্র বিক্রি করেছে। এ ছাড়াও পুনরায় নওয়াপাড়া থেকে ২ হাজার ৪৪০ বস্তা সার ট্রাকে লোড দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের অনুমতি চায়। এ সময় বিষয়গুলো সন্দেহজনক মনে হলে আকিজ রিসোর্সের ম্যানেজার এমরুল কায়েস অভয়নগর থানার মামলা দায়ের করেন। পুলিশ আসামিদের আটক করে স্বীকারোক্তি মোতাবেক নগদ অর্থ উদ্ধার করে আদালতে পাঠায়।
এদিকে, এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশের সর্ববৃহৎ সারের মোকাম নওয়াপাড়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে, আকিজ রিসোর্সের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্সের এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ইতঃপূর্বে একাধিকবার তাদের সার ধরা পড়লে তারা ট্রাক চালক-হেলপারের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দায় এড়ানোর মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে মের্সার্স বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেডের কর্মকর্তা মোহাম্মদ বাহাউদ্দিনের মোাবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীরা সরাসরি সরকারি সার বেচাকেনায় জড়িত। এটা একটি ওপেন সিক্রেট। তারপরও সার বিক্রির টাকা উদ্ধার হয়েছে প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব ঘটনায় গোটা মোকামে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বিগত দিনের মতো শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে নাটক করা হচ্ছে কি না, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসন তা খতিয়ে দেখলে প্রকৃত সত্য উঠে আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এর আগে ২০২৩ সালে নওয়াপাড়া থেকে চৌগাছা নেওয়ার পথে ট্রাকসহ ওই প্রতিষ্ঠানটির সার জব্দ করা হয়। সেই সময় দায় এড়াতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ট্রাক চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর একই বছরের ১৮ এপ্রিল নওয়াপাড়া রাজঘাটের নাহারঘাট থেকে মরক্কো থেকে আমদানিকৃত ৫০০ বস্তা টিএসপি জব্দ করা হয়। ওই সময় জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিলেন। তখনও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ট্রাক চালকের বিরুদ্ধে মামলা মামলা করা হয়।
সার ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, খুলনা ও নওয়াপাড়ার ঘাটগুলোতে নামানো ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার প্রতিনিয়ত কালোবাজারে বিক্রি হয়। এসব সার গুদামে বাব বরাদ্দ পাওয়া ডিলারের গুদামে সরবরাহ করার কথা বলে ট্রাকে ভরে সেগুলো চড়া দামে স্থানীয় ডিও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, গুদাম কর্তৃপক্ষ এবং পরিবহণ ব্যবসায়ীরা। তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাগজে-কলমে সংরক্ষণ দেখিয়ে বাইরে কমদামে সার বিক্রি করে। এতে অঞ্চলভেদে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্যরা অবৈধভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছে।
এ ব্যাপারে যশোর ডিবির ওসি মঞ্জুরুল হক ভুঞা জানান, কোম্পানির লোকজন ছাড়াও স্থানীয় একটি চক্র কালো বাজারে সার পাচারে জড়িত। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনায় মালিক পক্ষের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সার পাচারের ঘটনায় ইতিপূর্বে ওই প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলা আদালতে বিচারাধীন। তিনি আরও জানান, আত্মসাতকৃত সার উদ্ধারে তৎপরতা চলছে।


























