সোমবার ৩০ জুন ২০২৫

১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে একজন আলেক্সান্দ্র পুশকিন

রানার ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২২, ২৬ জুন ২০২৫

আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে একজন আলেক্সান্দ্র পুশকিন

আলেক্সান্দ্র সের্গেইয়েভিচ পুশকিন এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যা সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ইতিহাসে গভীরভাবে জড়িত ছিল। তার পিতা, সের্গেই লেভোভিচ পুশকিন ছিলেন এক সংস্কৃতিপ্রেমী অভিজাত, যিনি ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য ভালোবাসতেন। তার মাতা নাদেজদা অসিপভনা গন্নিবাল ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত একজন বুদ্ধিমতী নারী। তার মাতামহ আব্রাম পেত্রোভিচ গন্নিবাল ছিলেন একজন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সামরিক প্রকৌশলী, যিনি ছিলেন রাশিয়ার সম্রাট পিটার দ্য গ্রেট-এর পালকপুত্র।

১৮১১ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে পুশকিন ভর্তি হন তৎকালীন newly established এলিট বিদ্যাপীঠ-এ, বর্তমানে পুশকিন শহর। সেখানে তিনি রুশ ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে গভীর অনুরাগ অর্জন করেন এবং তার কাব্যিক প্রতিভা বিকাশ লাভ করে নানা প্রভাবে। বিশেষ করে পস্কভ অঞ্চলের Mikhaylovskoye Estate-এ যেখানে তারা বাস করত, সেখানের প্রভাব তার কবিতার শিল্পাঞ্চলজুড়ে ছিল। এ গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদী-খাল, অরণ্য ও শীতকালীন নিসর্গ তার কাব্যিক কল্পনার প্রধান উৎস হয়ে ওঠে। পুশকিন নিজেই এ সম্পর্কে বলেন: ‘I lived alone in the woods, listening to the murmur of the stream, and finding in nature the voice of poetry.’

পুশকিন শুধু আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনকই নন, বরং একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক অনন্য সাহিত্যিক সত্তা। পুশকিনের সাহিত্যে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণ রয়েছে। ইউরোপীয় ও আফ্রিকান উত্তরাধিকারের প্রতিফলন এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটানোর শৈল্পিক প্রবণতা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পুশকিনের সাহিত্যিক বিপ্লব কেবল ভাষাগত নয়, এটি রুশ পরিচিতি ও জাতিসত্তার আধুনিক গঠনে মৌলিক অবদান রেখেছে। তার কবিতা, নাটক এবং গদ্য একটি সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সূচনা করে যা ইউরোপীয় রোমান্টিকতাকে রুশ মাটিতে রূপান্তরিত করেছে।

যদি পুশকিন কখনো জন্মই না নিতেন, রুশ সাহিত্য হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর পশ্চিমা সাহিত্যের উপনিবেশ রূপে থেকে যেত। এ বিষয়ে বিভিন্ন বিখ্যাত মনীষীরা উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন। বিশেষ করে The New Republic, The New Yorker, I The New York Review of Books-এর মতো পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সমালোচক ও সম্পাদক এডমান্ড উইলসন পুশকিন সম্পর্কে বলেন: ‘If Pushkin had never existed, Russian literature might have remained a colony of the West for another fifty years.’

আধুনিক জাতিসত্তার বিবর্তনে সাহিত্য একটি মৌলিক ভূমিকা রাখে। পুশকিনের ক্ষেত্রে, এ ভূমিকা কেবল ভাষার রূপান্তরে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিচিতির নির্মাণেও কেন্দ্রীয় ছিল। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে পুশকিন নিজেই এক আন্তঃসাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ, যা তার সাহিত্যে একটি বৈশ্বিক বিস্তার ও অন্তর্ভুক্তির ধারা সৃষ্টি করে। এজন্যই পুশকিনকে ‘Russian Shakespeare’ বা ‘founder of modern Russian literature’ বলার পেছনে কেবল কাব্যিক দক্ষতা নয়, বরং একটি জাতির কণ্ঠস্বর নির্মাণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনও নিহিত ছিল।

এখানে লক্ষণীয়, পুশকিনের বংশগত ইতিহাস ছিল বহুমাত্রিক। তার প্রপিতামহ আব্রাম পেতরোভিচ গণিবাল ছিলেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত-সম্ভবত ইথিওপিয়ার বা ক্যামেরুন অঞ্চলের। যিনি পরবর্তী সময়ে পিটার দ্য গ্রেটের সান্নিধ্যে আসেন এবং সামরিক ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করেন। এ আন্তঃসাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ছায়া পুশকিনের সাহিত্যজগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে জাতীয় পরিচয় ও বৈশ্বিক সংযোগ একই প্রবাহে গঠিত হয়। তার বিখ্যাত আত্মজৈবনিক কাব্য ‘The Negro of Peter the Great’ আন্তঃসাংস্কৃতিক আত্মসচেতনতার এক প্রতীকী পাঠ।

পুশকিন প্রথম রুশ লেখক যিনি কথ্য রুশ ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তার লেখা যেমন ‘ইয়েভজেনি ওনেগিন’ রুশ সমাজের নানা শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে, তেমনি তিনি ভাষাগতভাবে সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। একজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রুশ-মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক জোসেফ ব্রডস্কি এ সম্পর্কে বলেন ‘Pushkin created not just a body of work, but a language for Russian literature.’ অর্থাৎ পুশকিন কেবল সাহিত্যকর্মই সৃষ্টি করেননি, তিনি রুশ সাহিত্যের জন্য একটি ভাষা নির্মাণ করেছেন। এ উক্তির মাধ্যমে ব্রডস্কি বোঝাতে চেয়েছেন, পুশকিন কেবল সাহিত্য রচনা করেননি, তিনি রুশ সাহিত্যকে একটি নতুন ভাষার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন, যেটি আধুনিক রুশ সাহিত্যিক ও কবিদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে এবং সে পথপরিক্রমায় আজও রুশ সাহিত্য উদ্ভাসিত।

পুশকিনের দাদা ইব্রাহিম গণিবাল ছিলেন একজন আফ্রিকান, যিনি পিটার দ্য গ্রেটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। পুশকিন তার উপন্যাস ‘The Moor of Peter the Great’-এ এই ইতিহাসকে রূপায়িত করেন। এ অভিজ্ঞান তাকে ‘অন্যান্য’-র অবস্থান থেকে লিখতে শেখায়, যার ফলে তার সাহিত্য হয়ে ওঠে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বৈশ্বিক। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপারেটিভ লিটারেচার ও স্লাভিক ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগের অধ্যাপক এবং একজন প্রখ্যাত মার্কিন গবেষক ও রুশ সাহিত্যবিদ ক্যারল এমারসন বলেন ‘Pushkin's African ancestry gave him an instinctive understanding of marginality, of the outsider's gaye.’-অর্থাৎ পুশকিনের আফ্রিকান বংশপরিচয় তাকে প্রান্তিক অবস্থান ও বহিরাগত দৃষ্টিভঙ্গির এক স্বাভাবিক উপলব্ধি দিয়েছে।

পুশকিন ইউরোপীয় রোমান্টিক কবিদের মতোই এক দৃষ্টান্তমূলক সাহিত্যিক, কিন্তু তার পার্থক্য হলো, তিনি এ রীতিকে রুশ বাস্তবতায় স্থানান্তর করেন। বাইরন, শেলি বা গ্যেটে যেমন আত্মবিশ্লেষণ ও ব্যক্তিক বেদনায় নিমগ্ন, পুশকিন তেমনই অথচ সমাজ-মনস্তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, ইংরেজ ভাষার সাহিত্যিক, সমালোচক ও ইতিহাসবিদ-ডি.এস. মিরস্কি বলেন ‘Pushkin is the Byron of Russia, but with a soul rooted in Slavic soil.’ এ মন্তব্য পুশকিনের সাহিত্যিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের স্বরূপকে সংক্ষিপ্ত অথচ গভীরভাবে তুলে ধরে।

বাইরনের মতো পুশকিনও নায়কোচিত আত্মচরিত্র নির্মাণে পারদর্শী, কিন্তু এ আত্মচরিত্র রুশ সমাজের এক প্রতিচ্ছবি। তার ‘স্লাভিক মাটিতে প্রোথিত আত্মা’ কেবল এক সংস্কৃতিগত অবস্থান নয়, বরং এক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান, যা পুশকিনকে ইউরোপীয় রোমান্টিকদের অনুরূপ নয়, বরং তাদের বিকল্প এক রুশ প্রতিস্বর হিসাবে স্থাপন করে।

প্রকৃতপক্ষে পুশকিন ইউরোপীয় রোমান্টিকতাবাদের রূপরীতিকে রাশিয়ার মাটিতে প্রতিস্থাপন করেন, কিন্তু অন্ধ অনুসরণে নয়, বরং এক সৃজনশীল রূপান্তরের মাধ্যমে। বাইরনের আত্মমগ্নতা, শেলির আদর্শবাদ কিংবা গোয়থের দার্শনিক গভীরতা-এ উপাদানগুলো পুশকিনের লেখায় অনুরণিত হলেও, তার কাব্যিক দৃষ্টি ছিল সমাজমনস্ক এবং জাতীয় আত্মসচেতনতায় সমৃদ্ধ। যেমন তার কাব্যনাট্য ‘Boris Godunov’ ইতিহাস ও রাজনীতির জটিল সম্পর্ককে তুলে ধরে, কিংবা ‘Eugene Onegin’-এ তিনি রাশিয়ার জমিদারি সমাজের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন এমন এক ভাষাশৈলীতে, যা ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমে দুর্লভ। পুশকিনের স্বাতন্ত্র্য এইখানেই ; তিনি রোমান্টিসিজমের আত্মনিমগ্ন ব্যক্তিকতা ও নন্দনতত্ত্বকে গ্রহণ করলেও, তা রুশ সমাজবাস্তবতার কাঠামোতে পুনর্গঠন করেন। তার ‘স্লাভিক আত্মা’ একদিকে লোকসাংস্কৃতিক উপাদানে প্রোথিত, অন্যদিকে ব্যক্তিমানবের অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ ও দ্রোহের অন্তর্জগতে ঋদ্ধ।

সেজন্যই পুশকিনের সাহিত্য রাশিয়ার সামাজিক, ঐতিহাসিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তরের নিরিখে এক যুগান্তকারী সংযোজন। তার জীবন ও কাজ একটি বহুসংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি; যেখানে তিনি রুশ চেতনাকে বৈশ্বিক সাহিত্য-মানচিত্রে স্থাপন করেছেন। বিশেষ করে তার Eugene Onegin- আধুনিক রুশ উপন্যাস-কবিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে আছে। Boris Godunov ইতিহাসনির্ভর নাটক, যা পরবর্তী সময়ে মুসর্গস্কির অপেরায় রূপ পায়। The Broûe Horseman পিটার দ্য গ্রেট ও রাশিয়ান রাজনীতির ওপর মহাকাব্যিক ব্যাখ্যা। The Queen of Spades গথিক ও মানসিক দ্বন্দ্বনির্ভর ছোটগল্প, যা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। The Captain's Daughter ঐতিহাসিক উপন্যাস, যেখানে পুশকিন রুশ বিপ্লব ও সমাজবিচার তুলে ধরেছেন।

রাশিয়ার বাইরেও তার সাহিত্য ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান, জাপানি ও বাংলাসহ অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বসাহিত্যে পুশকিনের স্টাইল, চরিত্র নির্মাণ এবং ভাষার সৃজনশীলতা সাহিত্য-গবেষক, দার্শনিক ও ভাষাবিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুশকিনের সাহিত্যের গভীর প্রশংসা করেন এবং তার নাট্যরীতির প্রভাব গ্রহণ করেন।

পুশকিন ছিলেন একান্তই রুশ, কিন্তু একইসঙ্গে আন্তঃসাংস্কৃতিক। তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের রীতি ও ভাবধারাকে রুশ ভূখণ্ডে প্রতিস্থাপন করে এক অভিনব সাহিত্যিক পথ খুলে দেন। তার সৃষ্টি রাশিয়ার জাতীয় আত্মচেতনার নির্মাণে যেমন অবদান রাখে, তেমনি বিশ্বসাহিত্যে এক অভিজ্ঞানী কণ্ঠস্বর হিসাবেও তাকে চিহ্নিত করে। মূলত পুশকিন আধুনিক রুশ সাহিত্যের পিতা হিসাবে কেবল ঐতিহাসিকভাবে নয়, আন্তঃসাংস্কৃতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অমর। তার সাহিত্যিক অবদান একটি নির্দিষ্ট জাতির সাহিত্যকেই নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সালমান রুশদি বলেন ‘Pushkin does not belong to Russia alone; he belongs to all of us who write, read, and dream.’

শেয়ার করুনঃ

আরো পড়ুন  

সর্বশেষ

শীর্ষ সংবাদ: